মঙ্গলবার ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

‘বাংলা ভাষা শেষ হয়ে যাবে না, কারণ পশ্চিমবঙ্গের কাছেই আছে বাংলাদেশ’

কলকাতা ডেস্ক   |   রবিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   15 বার পঠিত

‘বাংলা ভাষা শেষ হয়ে যাবে না, কারণ পশ্চিমবঙ্গের কাছেই আছে বাংলাদেশ’

বাংলা ভাষা কোনোদিন শেষ হয়ে যাবে না কারণ পশ্চিমবঙ্গের কাছেই আছে বাংলাদেশ। শনিবার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ‘বাংলাদেশ দিবস’ অনুষ্ঠানে ‘সংযোগের সেতুবন্ধন: সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এই মন্তব্য করেন বিশিষ্ট কবি ও পশ্চিমবঙ্গ কবিতা একাডেমির চেয়ারম্যান সুবোধ সরকার।

এদিনের সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। প্রধান আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সম্মানিত আলোচক হিসেবে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক চিন্ময় গুহ, আলোচক ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সম্মানিত অতিথি ছিলেন কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিবিদ চট্টোপাধ্যায়, গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু শেখর দে, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।

বইমেলা প্রাঙ্গণের এস.বি.আই অডিটরিয়ামে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সুবোধ সরকার বলেন, ‘সেতু জোর করে তৈরি হয় না। এটা হাওড়া ব্রিজ বা পদ্মা সেতু নয় যেখানে অনেক পয়সা লাগে, অনেক লোক লাগে। সেতুটা আমাদের মধ্যেই আছে, নতুন করে সেতু তৈরি করতে হবে না।’ বাংলা ভাষা, বাংলার বইমেলা ও বইমেলায় বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে সুবোধ বলেন, ‘কলকাতা বইমেলা এমন একটি বইমেলা যেখানে বাংলাদেশ ছাড়া কোনোদিন এই বইমেলা হয়নি, কোনোদিন হবেও না। আজকের দর্শকরাও যে টানে এখানে ছুটে এসেছেন, তার পেছনেও রয়েছে সেই বাংলা ভাষার প্রতি টান।’

সুবোধ সরকার বলেন, ‘অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ভারতের মতো এত ভাষাভাষীর দেশে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার কী হবে? কিন্তু আমি বলব বাংলাদেশের মত একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাকার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা কোনোদিন শেষ হয়ে যাবে না। যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঘ এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃষ্টি দিয়ে যায় বা তার উল্টোটা হয়, ঠিক সেভাবেই একটা সাংস্কৃতিক ঢেউ সর্বক্ষণ আছড়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতার উপর। এই ঢেউ কেউ কোনোদিন বন্ধ করে দিতে পারবে না। কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই যে এটা বন্ধ করে দিতে পারে। ভাষা তার নিজের প্রয়োজনে নিজের ঢেউ তৈরি করে নিতে পারে। সাহিত্য তার নিজের প্রয়োজনে এপারে ছুটে আসবে আবার ওপারে ছুটে যাবে। যেভাবে এপারে একটা ভালো গান তৈরি হলে তা ওপারে ছুটে যায়, তেমনি বাংলাদেশের একটা ভালো কবিতা তৈরি হলে তার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় পৌঁছে যায়।’

গত বছর কলকাতার নন্দনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রসঙ্গ টেনে সুবোধ সরকার বলেন, “বাংলাদেশের ‘হাওয়া’ ছবি দেখার জন্য শিশির মঞ্চ ছাড়িয়ে লম্বা লাইন এক্সাইড মরে চলে যায়, দীর্ঘকাল পর এরকম একটি ছবির জন্য এত দীর্ঘ লাইন দেখেছিলাম। কি করে হলো? কারণ একটা ভালো কবিতা, ভালো গান বা ভালো ছবি যেটা একই ভাষার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে সেটা যতটা সংযোগ তৈরি করতে পারে তা অন্য কিছু পারে না।’ এ প্রসঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের প্রশংসা করেন তিনি।

রাম মন্দির উদ্বোধন প্রসঙ্গ টেনে সুবোধ সরকার বলেন, ‘এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব একটা ঘটনার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা হচ্ছে রাম মন্দির। এই বই মেলা রাম মন্দিরকে চ্যালেঞ্জ। এই বইমেলা যে আসল মন্দির ও মসজিদ।’

সুবোধের পরেই বরেণ্য সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা নিজের বক্তব্যে বলেন, ‘সংযোগের সেতু বন্ধনের বিষয়টি একটু কৃত্রিম বলে আমার মনে হয়। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৫ সালে আমি যখন স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে এলাম, তখন কখনোই মনে হয়নি অন্য দেশ বা অন্য পরিবেশে এসেছি। ফলে তখন থেকেই সেতুবন্ধনের বিষয়টি ছিল না।’ তাঁর অভিমত- ‘দূরত্ব তৈরি করে এখন সেতু বাঁধা হচ্ছে। আমাদের দূরত্ব কোথায়? আমাদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭৫ থেকে আমার এই কলকাতায় আসা যাওয়া, আমার বন্ধুরা এখানে, আমার ভালো সময়, দুখের সময় কেটেছে এই বাংলায়। এক ভাষায় কথা বলে, আনন্দ, দুঃখ সব কিছুই এক। তাই দূরত্বটা একটা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা। আসলে আমরা দূরে চলে গেছি অন্যদের কারণে। এখানকার অধিকাংশ মানুষের শিকড় বাংলাদেশ, ফলে তারা যখন সে দেশ থেকে ঘুরে আসেন তখন তাদের মধ্যে সেই সেতু থাকে না।’

রেজওয়ানা বলেন, ‘বই আমাদের সাহিত্যের প্রধান অঙ্গ। ইন্টারনেটের যুগে আর দূরত্ব বলে কিছু নেই। এই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিয়ানা, বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। যেভাবে অন্য ভাষাভাষীর চাপ বাড়ছে সেখানে বাংলা ভাষা বলে আর কিছু থাকবে না। আমার আশঙ্কা একসময় রবীন্দ্রনাথকেই না হারিয়ে দিতে হয়।’

এদিকে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসব করার বিষয়টিও এদিনের সেমিনারের আলোচনায় বারবার উঠে আসে। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। দুই দেশের যৌথ আন্তর্জাতিক বইমেলার বিষয়ে এবং ঢাকার বইমেলায় কলকাতা স্টল দেওয়া যায় কি না সেই বিষয়ে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দেন খলিল আহমদ। তার অভিমত ‘বইয়ের বিকল্প বই। সমাজের এক এক শ্রেণির মানুষ এক এক ধরনের বই পড়ে থাকেন। বইমেলা বৃদ্ধি করছে বইয়ের চাহিদা। বইমেলা একজন লেখকের জীবিকা নির্বাহের তীর্থভূমি।’

বইমেলার আয়োজক সংস্থা গিল্ডের সম্পাদক সুধাংশু শেখর দে বলেন, ‘বই মেলার শুরু থেকেই অনেক প্রকাশক আসছেন। প্রচুর বই এখানে আসছে। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এক। দুই দেশের মধ্যে এর আদান-প্রদানটা খুব জরুরি। আমরা চাই বাংলাদেশের বইমেলাতে কলকাতা একটা স্টল পাক। সেখানে এখানকার বই বিক্রি করা হবে।’

ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সাহিত্য সংযোগের মাধ্যম হতে পারে বই। এই সংযোগ শুধু তখনই হতে পরে যখন বইয়ের আদান-প্রদান হতে পারে। আমরা চাই বইয়ের আদান প্রদান আরও বেশি হোক।’

চলতি বছরই জুন-জুলাই বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্য উৎসব ও বই মেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে ত্রিদিব বলেন, ‘এখানে বই মেলার পাশাপাশি এখানকার সাহিত্যিক, লেখকরা আলোচনায় অংশ নেবেন। যাতে সেদেশে এখানকার বইয়ের ক্ষুধা মিটবে।’

সাহিত্যিক ও অনুবাদক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আলোচনার মধ্যে দিয়ে অবশ্যই এই সংযোগের সেতুবন্ধন হয়। বই অবশ্যই সংযোগ ঘটায়। যেকোনো ভালো বই আত্মকথন বৃদ্ধি করে।’

চিন্ময় গুহ মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমরা সংস্কৃতির সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের অস্ত্র বা জাদু লণ্ঠন হল বই। পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বই। আনন্দ বা জ্ঞান লাভের জন্য নয়, বাঁচার জন্য বই পড়ুন। এমন বই পড়তে হবে যা আমাকে কামড়াবে, বিদ্ধ করবে। যে বই জমাট বরফ ভাঙার জন্য তৈরি হয়েছে।’

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘বাংলা ভাষায় যত গ্রন্থ আছে তা অন্য ভাষায় আছে কিনা জানা নেই। আমাদের একটা বিশ্ব ভাষা প্রয়োজন, সেখানে এই বাংলা ভাষা সেই স্থান নিতে চলেছে বলে মনে হয়। সেখানেই বই মেলার স্বার্থকতা।’

রামেন্দ্র মজুমদার বলেন ‘১৯৭১ সালে দুই দেশের মানুষের রক্তের মধ্যে দিয়ে নতুন করে সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে। আমাদের দুই দেশের যে রক্তের সম্পর্ক তা মাঝে মধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বাড়াতে পারলে যদি কেউ বিরুদ্ধাচরণও করতে চায় তা পারবে না। যদিও দুই দেশের সরকারের উপরেও তা নির্ভর করে। পশ্চিমবঙ্গের সাথে ত্রিপুরায় বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ানো উচিত। ভিসা প্রক্রিয়া সরলীকরণ করাও জরুরি।’

বাংলাদেশ পুস্তক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কলকাতা বইমেলায় একদিনকে বেছে নেওয়া হয় বাংলাদেশ দিবস হিসেবে। সেই দিনটি কার্যত মিনি বাংলাদেশে পরিণত হয়। এখানকার পাঠকরা সেভাবে বাংলাদেশকে চিনত না। কিন্তু বই মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সেদেশের লেখক, সাহিত্যিকদের বেশি করে চিনতে পারছেন। আমি বলব, বই না কিনলেও নেড়েচেড়ে দেখুন তবেই সেদেশের বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারবেন।’

এদিনের আলোচনা সভা শেষে সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উল্লেখ্য, গত ১৮ জানুয়ারি এই বইমেলার উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এবারের বই মেলার ফোকাল কান্ট্রি গ্রেট ব্রিটেন। মেলা চলবে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন খোলা থাকবে দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

এদিকে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঅধরা মানবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত রিকশা এবং রিকশাচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। ৩ হাজার ২০০ বর্গফুটের প্যাভিলিয়নে ৪৫টি (১২টি সরকারি ও ৩৩টি বেসরকারি) স্টল আছে।

Facebook Comments Box

Posted ১:৩২ পিএম | রবিবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৪

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।