| সোমবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 20 বার পঠিত
দেখতে দেখতে প্রায় একটি বছর হতে চলেছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ইউক্রেন দখল করার অভিপ্রায় থাকলেও এখনো সেই সফলতা আসেনি। চলছে লাগাতার লড়াই। তবে এতদিন পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে বিভিন্নভাবে থাকলেও এবার সরাসরি দেশটিকে সমর্থন করছে তারা। ভারী অস্ত্রসহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কিয়েভ মিত্ররা। কিয়েভকে ট্যাংক পাঠানোর কথা ঘোষণা করার দুদিনের মধ্যেই বোমারু বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই এক অদ্ভুত দাবি করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট ফিরে পেয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একের পর এক টুইট করছেন তিনি। সর্বশেষ টুইটে তার দাবি, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে যুদ্ধ শেষ করতে সময় লাগতো মাত্র ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো মধ্যস্থতায় বা শান্তি আলোচনায় সমস্যার সমাধানের আশা দেখা যাচ্ছে না। কারো কারো মতে, সমাধান এবার যুদ্ধের ময়দানেই হবে। মনে হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে পরাজিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
কেন যুদ্ধক্ষেত্রে সমাধানের কথা ?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এই মুহূর্তে আলোচনায় ‘লেপার্ড-২ এবং ‘এমওয়ান অ্যাব্রামস’ শব্দগুলো। প্রথমটি জার্মানির তৈরি ট্যাংক, যা কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা ও সিদ্ধান্তহীনতার পর শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে পাঠাতে রাজি হয়েছে দেশটি। ট্যাংক হলো সাঁজোয়া যান, যুদ্ধের ভারী সমরাস্ত্র। যা অনেক দূর থেকে যেমন গোলাবর্ষণ করতে পারে, আবার শত্রুর ট্যাংকও ধ্বংস করতে পারে। জার্মানি ১৪টি লেপার্ড-২ ট্যাংক-সহায়তা দেবে ইউক্রেনকে। এমন ঘোষণার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র জানায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারাও ইউক্রেনকে ৩১টি এমওয়ান অ্যাব্রামস ট্যাংক পাঠাবে।
ইউক্রেনকে ব্যাটেল ট্যাংক সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সে দেশে যুদ্ধবিমান ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ব্যাটেল ট্যাংক সরবরাহের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইউক্রেনের ওপর আরো হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। গত বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৫০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় কমপক্ষে ১১ জন নিহত হয়। রুশ স্থলবাহিনীও ইউক্রেনের পূর্ব প্রান্তে ৬০টিরও বেশি শহরের ওপর হামলা চালিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্যে আরো অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি বলেন, একমাত্র উপযুক্ত অস্ত্র দিয়েই রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব। তার মতে, ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহার করা প্রতিটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, প্রতিটি ইরানি ড্রোন আরো অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছেন, লবণ খনির শহর সোলেডার দখলের পর এবার ইউক্রেনের দোনেত্স্ক এলাকার আরেক শহর ভুহলেদরকে নিশানা করেছে রাশিয়া। দনবাসের পাশাপাশি নিপার নদীর তীরে অবস্থিত মধ্য-দক্ষিণ ইউক্রেনের নিপ্রো শহর দখলের লক্ষ্যেও গত দুই সপ্তাহ ধরে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বাহিনী।
এদিকে ট্যাংকের পর ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমারু বিমান পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এক উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬-এর মতো যুদ্ধবিমানের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ভয় না করে ইউক্রেনের গোটা ভূখণ্ডেই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ও এয়ার ডিফেন্স প্রণালি বসানোর ছাড়পত্র দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাটেউত্স মোরাভিয়েস্কি। ন্যাটো ইউক্রেনকে যুদ্ধ বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে তিনি পোল্যান্ডের সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের মতে, ইউক্রেনকে ব্যাটেল ট্যাংক সরবরাহের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ল আমেরিকা ও ইউরোপ।
কীভাবে পার্থক্য গড়বে ট্যাংক?
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া হামলা শুরুর পর থেকে অন্তত ৩০টির বেশি দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে এই পুরোটা সময় তারা ব্যবহার করেছে টি-৭২ ট্যাংক, সোভিয়েত আমলের অন্তত ৩০ বছরের পুরনো এই ট্যাংকগুলো ইউক্রেনে আগে থেকেই ছিল। এর পাশাপাশি পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্র প্রায় আরো ২০০টি এই টি-৭২ ট্যাংক ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে। কিন্তু যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার পর থেকে বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি পশ্চিমাদের কাছে আধুনিক ট্যাংক চেয়ে আসছিলেন। এবং তিনি দাবি করেন, ৩০০টি ট্যাংক পেলে ইউক্রেন রাশিয়ান বাহিনীকে হটিয়ে তাদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
এখন আক্রমণাত্মক যুদ্ধের সময় অত্যাধুনিক লেপার্ড-২ ও এমওয়ান অ্যাব্রামস ট্যাংকগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করবে। বিবিসির কাছে এমন মত দিয়েছেন সমর বিশেষজ্ঞ এবং মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী। তিনি জানান, পশ্চিমা নেতাদের আশঙ্কা শীতকাল শেষ হতেই রুশ বাহিনী একটা বড় আক্রমণে যাবে, আর এই সময় তাদের ট্যাংক দেওয়ার উদ্দেশ্য যাতে সেই আক্রমণের আগেই ইউক্রেন পালটা আক্রমণ করে তাদের হারানো অঞ্চল উদ্ধার করে নিতে পারে। তাই এই সময় ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠানো রাজনৈতিক ও সামরিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিশ্রুত ট্যাংক হাতে পেলে ইউক্রেনের বাহিনী আরো শক্তিশালী হবে সন্দেহ নেই। তাদের আক্রমণের গতি যেমন বাড়বে, নিশানাও নিখুঁত হবে। আর সঠিক কৌশল অবলম্বন করে ঠিকঠাক আক্রমণ করতে পারলে রুশ বাহিনীকে পিছু হটানোও সম্ভব। তবে সে লক্ষ্য অর্জনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ দেখছেন সৈয়দ মাহমুদ আলী। তার মতে, একটা সমস্যা হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো খুব জটিল, এগুলো সঠিকভাবে চালাতে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এতদিন ইউক্রেনীয় বাহিনী পুরনো ট্যাংক চালিয়েছে এখন তাদের নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রতিটি ট্যাংকের সঙ্গে থাকে আরো বেশ কিছু যুদ্ধ সরঞ্জাম। সেই সরঞ্জামগুলো দেখাশোনা করা বা যুদ্ধক্ষেত্রে ভেঙে গেলে তা মেরামত করার জন্য কারিগরি ব্যবস্থা এবং ওয়ার্কশপ থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন সমর বিশেষজ্ঞ মাহমুদ আলী। এছাড়া জ্বালানি ও গোলাবারুদের মজুত নিশ্চিত করা আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই ট্যাংকগুলো চালানোর ক্ষেত্রে। তিনি জানান, ‘এই ট্যাংকগুলোর ওজন ৭০ থেকে ৮০ টন। এগুলোর চলাচলের জন্য ভূমি দরকার, বরফ বা কাদা হলে কঠিন। নদী পার হতে সেতু লাগবে এবং সেটাকে এই ওজন বহনের ক্ষমতা নিতে হবে। এদিকে রাশিয়া হুঙ্কার দিয়েছে, অন্যসব ট্যাংকের মতো এসব ট্যাংকও পুড়িয়ে দেওয়া হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আবারও বলেছেন, তিনি নব্য নাত্সীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। জয়ী না হওয়ার পর্যন্ত লড়াই চলবে। আবার সাবেক রুশ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ তো বলেই দিয়েছেন, রাশিয়া যুদ্ধে হারলে ভবিষ্যতে তা পরমাণু যুদ্ধে রূপ নেবে। ইউক্রেনকে পশ্চিমা বিশ্বের একের পর এক সহায়তা আর রাশিয়ার হুঙ্কারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে শোরগোল ছিল তাও যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
ট্যাংক কতগুলো এবং কবে পাচ্ছে ইউক্রেন?
জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ব্যাটেল ট্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কানাডা এবং ইউরোপের কিছু দেশও নিজেদের ভান্ডার থেকে জার্মানিতে তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনকে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩২১টি ট্যাংকের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে বলে ইউক্রেন সরকার জানিয়েছে। যদিও তারা জানিয়েছিল, ৩০০ ট্যাংক পেলে তারা রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারবে। মার্চ বা এপ্রিল মাসেই জার্মানির লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পৌঁছে যেতে পারে। তবে ইউক্রেন যে দাবি করেছে যুদ্ধ জয়ের জন্য তাদের ৩০০টি ট্যাংক প্রয়োজন ঠিক সেই পরিমাণ ট্যাংক তারা এখনি পাচ্ছে না। তবে বিবিসির প্রতিরক্ষা সংবাদদাতা জোনাথন বিয়াল মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যদি ১০০টির মতো ট্যাংক ইউক্রেনের হাতে পৌঁছালেও সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
সবার প্রথমে যুক্তরাজ্য ঘোষণা দেয় কিয়েভকে ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক পাঠানোর। এটিও বেশ পুরনো হলেও এই ট্যাংকে এমন কামান রয়েছে যার সাহায্যে নিখুঁতভাবে আক্রমণ চালানো সম্ভব। লেপার্ড-২ ট্যাংক তুলনামূলকভাবে হালকা, ব্যবহার করা সহজ, দ্রুতগতির এবং জ্বালানিও কম লাগে। আর যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে ৩১টি অ্যাব্রামস ট্যাংক। তবে এখনো এই ট্যাংকগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। বিশেজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে প্রাইভেট কন্ট্রাকটরদের থেকে কিনে তারপর পাঠাবে। তাদের সংরক্ষিত ট্যাংক দেবে না।
Posted ১২:৪১ এএম | সোমবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩
| admin
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।