| বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 19 বার পঠিত
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, সারা তিন দিন আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউতে ভর্তি হন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তাঁকে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা দেওয়া হয়। হাবিবুর রহমান জানান, তাঁর কিডনির সঙ্গে ম্যাচ করতে কয়েকজন কিডনি রোগীর তথ্য মেলানো হয়। এর মধ্যে ৩৪ ও ৩৭ বছর বয়সী দুই নারীর সঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মিলে যায়। আত্মীয় না হওয়ায় এর বেশি মেলেনি। বাকিটা ওষুধ প্রয়োগে উপযোগী করা হয়েছে।
বিএসএমএমইউতে কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার দলে আরও ছিলেন হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদ মো. সাইফুল হোসাইন, সহযোগী অধ্যাপক ফারুক হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক কার্তিক চন্দ্র ঘোষসহ ১৫ চিকিৎসক। তাঁরা জানান, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে দাতার কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অস্ত্রোপচারে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। এরপর কিডনিটিকে প্রতিস্থাপনযোগ্য করতে আধা ঘণ্টা লাগে। কিডনি প্রতিস্থাপনে সময় লাগে আরও দুই ঘণ্টা।
কিডনি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অধ্যাপক এ কে এম খুরশিদুল আলমের নেতৃত্বে ৩৭ বছর বয়সী নারীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। মৃত ব্যক্তি বলতে এখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ‘ব্রেন ডেথ’ অনেক রোগী থাকেন। তাঁরা আর বাঁচেন না। তাঁদের হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস ফ্লুইডের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিছুদিন চালু রাখা যায়।
কোনো ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হওয়ার পর কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে হৃৎপিণ্ড থেমে গেলেও কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়। এমন ব্যক্তিদের কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে দিকনির্দেশনা, তদারকি ও পরামর্শ দেওয়ার কাজ করে ‘ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি’।
দেশে কত কিডনি রোগী আছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’ অনুসারে, দেশে সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে কিডনি জটিলতায় মৃত্যুর স্থান ৮ নম্বরে। কিডনি জটিলতায় ৩ শতাংশের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। জীবিত ব্যক্তিদের দানে কত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, সে তথ্যও নেই। বিএসএমএমইউতে সপ্তাহে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
এদিকে সারার মায়ের সংগে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ মুহূর্তে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই বলে জানান। আজ জোহরের নামাজের পর আজিমপুর কবরস্থানে সারাকে দাফন করা হবে।
২০১৯ সাল থেকে মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেয় বিএসএমএমইউ। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন লজিস্টিক সহায়তাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রিফ কাউন্সিলর (শোকার্ত মানুষকে মানসিক সহায়তাদানকারী) গঠন, অন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি কাজ শুরু করা হয়।
বিএসএমএমইউ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রয়োজন—এমন ৫০ রোগীর তালিকা করে বিএসএমএমইউ। এর মধ্যে অন্তত তিনবার মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা যায়নি।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য ও ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান শারফুদ্দিন আহমেদ গত ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ প্রথমবারের মতো শুরু করতে চাই। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
মরণোত্তর দানের কিডনি প্রতিস্থাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএসএমএমইউ। এ জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউর আইসিইউর সঙ্গে বিএসএমএমইউ চুক্তি করেছে। সেখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত আইসিইউর রোগীদের পরিবার সম্মতি দিলে কিডনি নেওয়া হবে।
ছয় মাস ধরে বেশ কয়েকবার এমন কিডনি পাওয়ার ব্যবস্থা হলেও তা সংগ্রহ করা যায়নি। এক রোগী ছিলেন বিএসএমএমইউর আইসিইউতে। ওই রোগীর পরিবার কিডনি দান করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আইসিইউ থেকে ওই রোগীর টিউব খুলে ফেলা হয়। এ কারণে আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের ভুলে শেষ মুহূর্তে সংগ্রহ করা যায়নি। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক রোগীর ক্ষেত্রে। বছরখানেক আগে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এক রোগী ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হলে পরিবার কিডনি দিতে সম্মত হয়। তবে ভোরবেলা রোগীর মৃত্যু হলে পরিবারটি মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। হাসপাতাল থেকেও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জাতীয় ক্যাডাভেরিক কমিটির অংশ হিসেবে কাজ করে বিএসএমএমইউর ক্যাডাভেরিক সেল। ওই সেলের প্রধান বিএসএমএমইউর প্রক্টর ও ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রেন ডেথ’ ব্যক্তির কিডনি ছয় ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যায়। মরণোত্তর কিডনি দানকে কর্নিয়া দানের মতো সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। যাঁদের কিডনি পাওয়ার কোনো উৎস নেই এবং যাঁদের দ্রুত প্রয়োজন, তাঁদের অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা করা হয়েছে।
কিডনি প্রতিস্থাপনে বিএসএমএমইউর করা ৫০ রোগীর তালিকায় থাকা এক নারী রোগী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সমস্যা আগের চেয়ে জটিল হওয়ায় ডায়ালাইসিস শুরু করেছেন। প্রতিস্থাপনযোগ্য কিডনির অপেক্ষায় আছেন।
বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গত ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ভারতেও সাত থেকে আট বছর আগে মরণোত্তর কিডনি দান শুরু হয়েছে। কিডনি সংগ্রহের পর তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে। উন্নত দেশগুলো ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কিডনি সংরক্ষণ করতে পারে। আমাদের এখনো ততটা ভালো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনায় ‘ব্রেন ডেথ’ রোগীদের কিডনি সবচেয়ে সুস্থ থাকে। তাই তাদের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন—মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন।
তবে আইনের ফাঁক গলিয়ে অবৈধভাবে দেশে কিডনি কেনাবেচা হচ্ছে। এখন একটি কিডনি কিনতে ন্যূনতম সাত লাখ টাকা লাগে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি কেনাবেচার চক্রও আছে। এমন চক্রগুলো একেকটি কিডনির জন্য ২০ লাখ টাকাও নিয়ে থাকে। অনেকে কিডনিদাতাকে নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে প্রতিস্থাপন করেন।
Posted ৮:০১ এএম | বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩
| admin
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।