শনিবার ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

সাভারে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ ট্যানারি শ্রমিকদের

ডেস্ক রিপোর্ট   |   সোমবার, ১০ জুন ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   96 বার পঠিত

সাভারে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ ট্যানারি শ্রমিকদের

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৭ বছর আগে। তবে চামড়া শিল্পনগরের অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কমপ্লায়েন্সের অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় চামড়ার মূল্য কমেছে। আবার ট্যানারির শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবাসন, চিকিৎসাসহ শ্রমিকদের জীবন-যাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নেই যথাযথ ব্যবস্থা। অসুখ-বিসুখ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল তারা। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে কেউ পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছেন, কেউ সন্তানকে স্কুলছাড়া করেছেন। শ্রমঘন ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প এলাকাটির ১৫৫টি প্লটে প্রায় ২০০ ট্যানারিতে কর্মরত ৮ হাজার শ্রমিকের জীবন যাচ্ছে এভাবেই।

গত ৮ মে সরেজমিনে দেখা যায়, ট্যানারিগুলোতে উৎপাদন চলছে। টানাগাড়ি ও ভ্যানে করে ট্যানারিতে আসছে চামড়া। সেই চামড়া কাঁধে বয়ে কারাখানায় ঢোকাচ্ছেন শ্রমিকরা। বেশ কিছু ট্যানারি কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রস্তুতি সেরেছে। অনেকে এরই মধ্যে মজুত করেছেন লবণসহ অন্যান্য কাঁচামাল।

তবে এই শিল্পনগরে কর্মরত বেশিরভাগ শ্রমিক জানিয়েছেন, মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত গ্রেড নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের বেতন নির্ধারিত হয়। এছাড়া ওভারটাইম ও ছুটির সুবিধা তারা পান না। তাদের নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা। সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করতে পারেন না তারা।

ট্যানারিগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। ফড়িয়া বা দালালরা বাইরে থেকে চামড়া এনে বিভিন্ন ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করেন। তারা বেশিরভাগই অস্থায়ী শ্রমিকদের কাজে লাগান। অন্যদিকে অনেক কারখানাও অস্থায়ী শ্রমিকদের ব্যবহার করেন। নবীশ শ্রমিকদের এখানে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। তাদের দেওয়া হয় ‘হাত খরচ’। ট্যানারিভেদে স্বল্প অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার ও অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। ট্যানারিগুলোতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও নগণ্য।

সংগঠনগুলো বলছে, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রতি দুই বছর পর পরই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করে আসছে। তবে মালিকরা সব সময়ই পুরো চুক্তি বাস্তবায়নে অনীহা দেখান। যার ফলে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, মালিকদের দুটি সংগঠনের সঙ্গে আমরা প্রায় ২২টি সিবিএ চুক্তি করেছি। প্রতি ২ বছর পর এসব চুক্তি হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি ও সিবিএ চুক্তির যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে শ্রমিকদের সমস্যা দূর হতো। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে চলে আসে ট্যানারিগুলো। তার পরের বছরই ট্যানারি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে মজুরি বোর্ড। যেখানে ট্যানারি শ্রমিকদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে ৫টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয়। শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করা হয় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা।

তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৬৯ শতাংশ ট্যানারি কোনো গ্রেডিংয়ের ধার ধারে না। ট্যানারি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ শীর্ষক ওই জরিপে বলা হয়, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের ট্যানারি শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি অনেক কম। সাভারে ৩৫টি ট্যানারি শ্রমিকদের মধ্যে জরিপটি করা হয়।

এ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, চুক্তির শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে কোনো শ্রমিকেরই অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে থাকার কথা নয়। তবে স্থায়ী কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করেও ‘স্থায়ী’ হতে পারেননি। দীর্ঘ সময় পরও তাদের অস্থায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করে স্থায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শ্রমিকদের জন্য আবাসন ও চিকিৎসা সুবিধা দিতে চাইছেন না মালিকরা।

বেতন কম, সংসার চলে না

সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হরিণধরা, ঝাউচর, জাদুরচর এলাকায় বেশিরভাগ ট্যানারি শ্রমিক বাস করেন। তবে একটি অংশের শ্রমিক থাকেন পুরাতন ঢাকায়। তাদের আনা নেওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। ট্যানারির ৩ ও ৪ নং গেটে এসব বাস রাখা হয়।

ওই এলাকায় অ্যাপেক্স ট্যানারি সংলগ্ন চায়ের দোকানে কথা হয় ট্যানারি শ্রমিক আবদুল আহাদের সঙ্গে। বে, অ্যাপেক্সসহ বেশ কিছু ট্যানারিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। এই শ্রমিক বলেন, ন্যূনতম মজুরি পাই না বেশিরভাগ শ্রমিক। যে টাকা বেতন পাই, তা দিয়ে সাভারে সংসার চালানো সম্ভব না। হাজারীবাগ থেকে যারা আসে, তাদের অনেকের নিজস্ব বাসা আছে। তাদের বাসার ভাড়া দেওয়া লাগে না, এ কারণে কিছুটা রয়ে সয়ে চলতে পারে। সাভারে থাকা বেশিরভাগ শ্রমিক ঋণ করে চলে।

তিনি বলেন, হাজারীবাগে ৩-৪ বছর কাজ করেছি। এখানে ৭ বছর ধরে কাজ করছি। আমার মতো শ্রমিকরা ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বেতন পাই। এই বেতনে সংসার চলে না। করোনার পরে বউ-বাচ্চা বরিশাল পাঠিয়ে দিয়েছি। এত খরচ বেড়েছে যে, বেতন দিয়ে চলে না।

দোকানে বসা আরেক শ্রমিক বলেন, সমবায় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে চলে অনেক পরিবার। পরে মাসিক কিস্তিতে সেই ঋণ পরিশোধ করে। আমি একটার কিস্তি চালাই, মাসে ১৮০০ টাকা করে। গত বছর স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম।

মাদারীপুরের ডাসার থেকে এসে ভুলুয়া ট্যানারিতে কাজ করছেন শাহজাহান আলী। তিনি থাকছেন ঝাউচর কাঁচাবাজার এলাকার টিনসেডের একটি বাসায়। তিনি বলেন, তিন মাস ধরে কাজ করছি। এখনো বেতন নির্ধারণ করা হয়নি। সামান্য কিছু হাত খরচ ধরা হয়েছে।

বাসা ভাড়া ও থাকা খাওয়ার খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে আড়াইহাজার টাকার নিচে কোনো রুম নেই। কোনো রুমে দুজনও থাকে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মিলিয়ে শুধু থাকাতেই ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। খাওয়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে একজন শ্রমিকের ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়।

তিনি আরও বলেন, কমপ্লায়েন্সের অভাবে আমাদের উৎপাদন কমেছে। ইউনিট প্রাইস অনেক কমে গেছে। ২০১৭ সালের আগে দেড় ডলারে চামড়া রপ্তানি করতাম। সেটা এখন ৭০ সেন্টে রপ্তানি করতে হচ্ছে। চামড়ার মূল্য নির্ধারণ আমরা করছি না। সাভারের কোনো ট্যানারি এলডাব্লিউজি সার্টিফিকেট পায়নি।

শ্রমিকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউনিয়নভুক্ত ট্যানারিগুলো চুক্তি বাস্তবায়ন করছে। ইউনিয়নের বাইরে ছোট ছোট ট্যানারি যেগুলো আছে, তারা রপ্তানি করতে পারছে না। অভ্যন্তরীণভাবে কিছু ব্যবসা করছে। তারা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারছে না।

 

Facebook Comments Box

Posted ৫:৩৮ এএম | সোমবার, ১০ জুন ২০২৪

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।