শনিবার ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

ছড়িয়ে পড়ছে রাসেলস ভাইপার, অ্যান্টিভেনম নিয়ে শঙ্কা

ডেস্ক রিপোর্ট   |   মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   52 বার পঠিত

ছড়িয়ে পড়ছে রাসেলস ভাইপার, অ্যান্টিভেনম নিয়ে শঙ্কা

কয়েক বছর ধরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপ। বিশেষ করে পদ্মাবেষ্টিত জেলাগুলোয় এখন রাসেলস ভাইপারের দংশন মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। পদ্মা ও মেঘনা হয়ে এই সাপ এখন চাঁদপুর, চট্টগ্রামেও পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।

রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ায় এর দংশনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে এর অ্যান্টিভেনম না পাওয়ায় বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হলেও এখনও বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরি করেনি দেশীয় কোনো ওষুধ প্রতিষ্ঠান। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ভারত থেকে অ্যান্টিভেনম আমদানি করে দেশে সরবরাহ করে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায় না।

সাপের দংশনের শিকার চার লক্ষাধিক মানুষ
২০২৩ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) করা গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় চার লাখ তিন হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

সম্প্রতি পদ্মার তীরঘেঁষা পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর ডিক্রির চরে রাসেলস ভাইপারের দংশনে মারা যান কৃষক হাফিজুর রহমান সোহেল। ৪২ বছর বয়সি এ ব্যক্তির আত্মীয় হাসান আদিব জানান, পদ্মার চরের মাঠে সাপে কাটার পর সোহেলকে উদ্ধার করে প্রথমে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কোথাও রাসেলস ভাইপার সাপের অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান।

হাসান আদিব বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, উত্তরাঞ্চলে শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) অ্যান্টিভেনম রয়েছে। কিন্তু কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোরের ফসলের মাঠে রাসেলস ভাইপার সাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এসব জেলা থেকে এ সাপে কামড়ানো রোগী রাজশাহীতে নিতেই আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। চিকিৎসকরা জানান, সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিট অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যেই ভেনম দিতে হবে। কুষ্টিয়া ও পাবনার হাসপাতালগুলোতে সেই ব্যবস্থাও নেই। অথচ পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ ও মেহেরপুরে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি।

এ ঘটনার কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিনুর রহমান সাব্বির রাসেলস ভাইপারের দংশনে মারা যান। তার সহপাঠী ও বন্ধুরা জানান, কয়েকজন বন্ধু মিলে পদ্মা পাড়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন সাব্বির। এসময় জিলাপি খেয়ে ফেলে দেওয়া কাগজের প্যাকেট আবার হাত মোছার জন্য নিতে গিয়েই রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হন। সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে।

চলতি বছর এ পর্যন্ত পদ্মার তীরবর্তী রাজশাহী, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় রাসেলস ভাইপারের দংশনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মাঝে চলতি বছরের মার্চ থেকে মে, গত তিন মাসে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চরাঞ্চলেই বিষধর রাসেলস ভাইপারের দংশনে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন।

অ্যান্টিভেনম আসে ভারত থেকে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, সাপের দংশনে রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি, ধরন একেক রকম। ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। অথচ বছরের পর বছর ভারতে তৈরি অ্যান্টিভেনম দিয়েই বাংলাদেশে সাপের দংশনের শিকার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সাপের ভেনম তৈরির গবেষণা চলছে
সাপের দংশনে মৃত্যু কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দেশে বিচরণ করা সাপের ভেনম তৈরির গবেষণা চলছে।

ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, ‘সাপের কামড়ের ওপর আমরা জাতীয়ভাবে জরিপ করেছি। এতে দেখেছি দেশে প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার ৫০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর চার লাখের বেশি আমাদের দেশে সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে।’

ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, ‘আমাদের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিষধর সাপ সংগ্রহ করা। তারপর তাদের লালন-পালন করা ও বিষ সংগ্রহ করা। বর্তমানে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজ চলছে। আমাদের দেশের ১১ জাতের বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে দ্রুত অ্যান্টিভেনম তৈরি সম্ভব নয়। এর প্রক্রিয়া অনেক লম্বা। এখন এ ভেনমের অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান। আবার এ ধাপের অনেক পরীক্ষা আমাদের দেশে হয় না। সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর সহযোগিতায় কিছু ভেনম স্পেনের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ভেনমের স্বভাব চিহ্নিত করতে হবে।’

বাংলাদেশে বিষধর সাপের ধরন
বাংলাদেশে অনেক সাপ দংশন করলেও বিষধর নয় এমন সাপের সংখ্যাই বেশি। দেশে সাধারণ বিষধর সাপ এলাপিড গ্রুপ (এলাপিড হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রাপ্ত বিষধর সাপগুলোর একটি পরিবার। এর মূল বিস্তৃতি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে)। এখন পর্যন্ত এ পরিবারভুক্ত ৬১টি এবং ৩২৫টি প্রজাতির কথা জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে গোখরা। ভাইপারিডি যা ভাইপার বা ভাইপারিডস নামেও পরিচিত। এটি পৃথিবীতে প্রাপ্ত বিষধর সাপগুলোর চারটি পরিবারের একটি। অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, মাদাগাস্কার, হাওয়াই, এবং আর্কটিক মেরুবৃত্তীয় অঞ্চল ব্যতীত বিশ্বজুড়েই এটির বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়। ভাইপারিডি গ্রুপে আছে সবুজ সাপ বা গ্রিন ভাইপার ও আরেকটি রাসেলস ভাইপার। এগুলো আমাদের দেশের বিষধর সাপ।

দ্রুত হচ্ছে রাসেলস ভাইপারের বংশ বৃদ্ধি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, দেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর। সবচেয়ে বিষধর হলো রাসেলস ভাইপার। রাসেলস ভাইপার শুকনো বা ভাটি অঞ্চলে থাকে। তবে এরা পানিতেও সমান ভাবে থাকতে পারে। এরা ডিম না পেড়ে বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় এদের প্রজনন বেশি। অনেক ক্ষেত্রে চরাঞ্চলে কচুরিপানার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকতে পারে।

অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, রাসেলস ভাইপার একসঙ্গে অনেক বাচ্চা জন্ম দেয়। অনেক বছর দেশে রাসেলস ভাইপারের খবর ছিল না। ২০১১-১২ সালের দিকে রাজশাহীর তানোরে রাসেলস ভাইপার দেখা যায়। এরপর রাজশাহীতে সীমাবদ্ধ না থেকে পদ্মা, যমুনা দিয়ে মেঘনা হয়ে চাঁদপুরে যায়। এখন মানিকগঞ্জে অনেক পাওয়া যাচ্ছে। পানির অববাহিকা দিয়ে রাসেলস ভাইপার চলাচল করে। রাসেলস ভাইপার দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েও পড়ছে।

অন্যদিকে, রাসেলস ভাইপারের রং অনেকটা জমির রঙের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় কৃষকরা ঠিকমতো খেয়াল করেন না। কাজ করতে গিয়ে দংশনের শিকার হন।

এই অ্যান্টিবডি আলাদাকরণ ও পিউরিফিকেশনের ফলাফল দেওয়া এবছরের মধ্যে সম্ভব জানিয়ে ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, ‘অ্যান্টিবডি আলাদাকরণের তথ্য নিয়ে আমাদের প্রজেক্ট এ বছর শেষ হবে। এছাড়া সামনে ভালো পরিমাণ ভেনম যদি থাকে, ম্যাপিং করা থাকে এবং ক্যারেক্টার আলাদা করার কাজ হয়ে যায় তাহলে আমরা অ্যান্টিভেনম বানানোর প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে যাবো।

 

Facebook Comments Box

Posted ৮:০৪ এএম | মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।