রবিবার ২০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

আরব দেশগুলো সাহস দেখানোর এই সুযোগ আর পাবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   156 বার পঠিত

আরব দেশগুলো সাহস দেখানোর এই সুযোগ আর পাবে?

মধ্যপ্রাচ্য এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ এক মোড়ে। এই মুহূর্তে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নিতে হবে। তা না হলে তাদের কেবল ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজই বাকি থাকবে।

সব দিক থেকেই মনে হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য এক সন্ধিক্ষণে আছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে তাদের বেশি শক্তি খরচের জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত দৃষ্টি এখন এশিয়ার দিকে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোড় ঘোরানো (পিভট টু এশিয়া) নীতির প্রবক্তা। এর পর থেকে প্রতিটি মার্কিন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো সংকটে তারা আবার এই অঞ্চলে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় সেই সংকট তাদের তৈরি করা নয়। এবং তা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুতে কৌশলগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার একটা বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তাঁর প্রশাসন নব্য-রক্ষণশীল প্রভাব কমিয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে জোর দেয়। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পায় যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় এই যে জায়গা খালি হবে, সেখানে এখন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কেবল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে নয়, বরং কৌশলপ্রণেতা হিসেবে উঠে আসার সময়।

কাতার, ওমান আর সৌদি আরব এই সুযোগ কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছিল। তারা ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে মিলে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে তেহরানের সঙ্গে নতুন এক কাঠামো গড়তে কাজ করছিল। একটি আঞ্চলিক মীমাংসার রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল। উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করেছিল, তারা আর শুধু পৃষ্ঠপোষক নয়, বরং এখন কৌশলপ্রণেতা। অর্থনৈতিক সংযুক্তি আর সমন্বিত পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছিল তারা।

এইভাবে এগোতে পারলে তা হতে পারত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যুদ্ধের বদলে জায়গা পেতে পারত পারস্পরিক নির্ভরতা আর অহিংস নেতৃত্ব।

কিন্তু এই স্বপ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিল। সেটি হলো—ইসরায়েল।

উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চল নিজেদের মতো করে বদলে ফেলতে পারে। তাদের হাতে উপায় আছে। আছে সময়ও। কিন্তু তারা ভুগছে দ্বিধায়। ১৯৭৩ সালের তেল-সংকটের মতো এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা।

নাটকীয় উত্তেজনা

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দীর্ঘদিনের কৌশল বদলে ফেলেন। আগে তিনি সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত হামলা চালাতেন। কিন্তু এখন তিনি হয়ে উঠলেন চূড়ান্ত উগ্র, একপেশে।

গাজায় এখনো নিশ্চিত বিজয় পায়নি ইসরায়েল। কিন্তু হিজবুল্লাহকে তারা কার্যত ঠেকিয়ে দিয়েছে। দুর্বল করেছে তাদের নেতৃত্বকে। এই আংশিক সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নেতানিয়াহু এবার ইরানের গভীরে আঘাত হানছেন। তাঁর লক্ষ্য—ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতার সম্ভাবনা নষ্ট করা।

নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপ মূলত ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক উদ্যোগ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ইরানবিরোধী শক্তি কোণঠাসা হচ্ছিল। তখন নেতানিয়াহু নিজের প্রভাব হারানোর ভয় পাচ্ছিলেন। এখন যুদ্ধ শুরু করে নেতানিয়াহু আবার কেন্দ্রে ফিরেছেন। তিনি ট্রাম্পকে এমন এক সংঘাতে টেনে এনেছেন, যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ভন্ডুল করে দিতে পারে ইরান চুক্তি।

কৌশল মানে হলো, নিজের স্বার্থ অনুযায়ী পরিবেশকে বদলানো। উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চল নিজেদের মতো করে বদলে ফেলতে পারে। তাদের হাতে উপায় আছে। আছে সময়ও। কিন্তু তারা এখনো দ্বিধায় আছে।

১৯৭৩ সালের তেল–সংকটের মতো এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। সেবার সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করেছিল। আজ উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতে আরও বেশি অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক আর জ্বালানি-সম্পর্কিত সামর্থ্য আছে। তারা বিশ্বে এই সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে প্রভাব তৈরি করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করতে সেই ক্ষমতা এখনো ব্যবহার করতে চায় না।

ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে হুতি বা হামাসের ওপর প্রভাব পর্যন্ত—সবই আছে। তবু তারা লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি বেছে নিয়েছে। ট্রাম্পকে বিনিয়োগ বা জ্বালানি চুক্তি দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েলের শক্তি প্রদর্শন আর সেনা হুমকির সঙ্গে এই কৌশল কাজ করছে না।

উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝতে হবে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। তাদের আছে শক্তি, আছে ক্ষমতা। এখন দরকার সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সাহস।

আঞ্চলিক রূপান্তর

ইসরায়েল তার সব সামরিক প্রযুক্তি, গোয়েন্দা দক্ষতা ব্যবহার করছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের নীতিকে নিজেদের মতো করে গড়ে নিচ্ছে। এই নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু নেতানিয়াহুর তাতে কিছু এসে যায় না। যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে জড়াতে পারলেই তার লাভ।

কিন্তু ইরান ইরাক নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই সেখানে স্থলসেনা পাঠাবে না। বরং তারা একটু একটু করে ইরানকে দুর্বল করার নীতি নেবে। একেকটা হামলা করে ইরানকে ফাঁপা করে তোলা হবে। যদি সর্বোচ্চ নেতা খামেনি নিহত হন, তাহলে দীর্ঘ আর জটিল উত্তরাধিকার সংকট শুরু হবে। শেষমেশ হয়তো আইআরজিসি-নেতৃত্বাধীন সামরিক স্বৈরশাসন তৈরি হবে। অথবা ইরান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। ইসরায়েল তখন জর্ডান আর ইরাকের পেছনে সরে গিয়ে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কাঁধে পড়বে সেই অস্থিরতার বোঝা। তাদের পাশে থাকবে এক বিধ্বস্ত প্রতিবেশী, ভাঙা সীমান্ত আর অসংখ্য সশস্ত্র নেটওয়ার্ক। যারা কোনো দিন উধাও হবে না, বরং নতুন রূপে গড়ে উঠবে।

নতুন আঞ্চলিক চিত্র

শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইরান বিপ্লবের আগেও ছিল। তারা লেবাননের গৃহযুদ্ধে লড়েছে। রাষ্ট্র ভেঙে গেলে তারা নতুনভাবে গড়ে উঠবে। তখন তারা হবে আরও কম দায়বদ্ধ আর কম নিয়ন্ত্রিত। ফলে এক ভারসাম্যহীন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি হবে। ইসরায়েল শত্রু ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু টেকসই কিছু তৈরি করতে পারবে না। আর উপসাগরীয় দেশগুলোকে ঘিরে থাকবে শত্রু সশস্ত্র গোষ্ঠী—হিজবুল্লাহ, হুতি আর ইরানি মিলিশিয়া। মাঝেমধ্যে ইসরায়েল হামলা চালিয়ে এদের কিছুটা দমন করতে পারবে। কিন্তু স্থিতিশীলতা ফিরবে না।

আরও খারাপ হলো, নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরায়েল এখন মৌলবাদী ইহুদি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এমন রাষ্ট্র যুদ্ধপ্রিয়, প্রতিবেশীদের স্বার্থের প্রতি উদাসীন। এমন রাষ্ট্র কোনো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এরা বিধ্বংসী শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলোকে শুধু অর্থ বা কূটনীতির জগতে নয়, কৌশলগত ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রভাব কাজে লাগাতে হবে। তাদের উচিত ওয়াশিংটনে নতুনভাবে লবি গড়ে তোলা। ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন তারা সংঘাত নয়, কূটনীতি বেছে নেয়। কাতার-ওমান এরই মধ্যে একধরনের সেতু গড়ছে তেহরান আর ট্রাম্পের মধ্যে। তাদের বহুমুখী অংশীদারত্বকেও কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব এখন বহু মেরু। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযুক্তি, রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ—সবই যুক্তরাষ্ট্রকে আরও গুরুত্ব দিতে বাধ্য করবে।

সবশেষে উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝতে হবে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। তারা শুধু অর্থ বা কূটনীতিতে নয়, কৌশলগত ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। তাদের আছে শক্তি, তাদের আছে ক্ষমতা। এখন দরকার সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সাহস।

মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য তারা এগিয়ে আসতে পারে। না হলে তাদের কাজ হবে শুধু সেই ভবিষ্যতের ধ্বংসাবশেষ সরানো।

Facebook Comments Box

Posted ৩:১১ পিএম | শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

মোদির নতুন চাল
(285 বার পঠিত)
ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।