মঙ্গলবার ২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু-‘বিজ্ঞানের বিস্ময়”

  |   বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২   |   প্রিন্ট   |   137 বার পঠিত

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ ঘটেছিল সেই মহালগ্নে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র আবির্ভাব। প্রাচীনকালে ভারতে দর্শন বিজ্ঞান সাক্ষী হয়েছিল প্রভূত উন্নতির। কিন্তু পরবর্তীকালে অধঃপতিত জাতির দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে এসেছিল এক অবাঞ্ছিত বিচ্ছেদ আর সেই অবরুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন বিজ্ঞানের বরপুত্র আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু । তাঁর বিজ্ঞান সাধনার মাধ্যমেই প্রাচ্যের দর্শন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের নতুন সেতুবন্ধন হয়েছিল।

বিজ্ঞানে জগদীশ চন্দ্র বসু যে অবদান রেখে গেছেন তা সারা বিশ্ব সারাজীবন মনে রাখবে। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার এক পর্যায়ে তিনি এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা দেখে হতবাক হয়ে যায় সারা বিশ্ব।

তিনি এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার যেটার মাধ্যমে তার ছাড়াই বার্তা প্রেরণ করা সম্ভব হয়।আর তার এই আবিষ্কারের হাত ধরেই পরবর্তীতে আবিষ্কার হয় বর্তমানে সময়ের সবচেয়ে সেরা আবিষ্কার মোবাইল ফোন,রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট।বিজ্ঞান যার ধ্যান জ্ঞান তিনি কি আর একটা আবিষ্কারে বসে থাকতে পারেন!

উদ্ভিদ নিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসুর চিন্তা ভাবনা যেন আরো গভীর আর এই গভীর চিন্তা ভাবনার এক পর্যায়ে তিনি আবিষ্কার করেন উদ্ভিদ দেহে প্রাণের অস্তিত্ব। তিনি আরো প্রমাণ করেন আমাদের মত উদ্ভিদরাও ঠাণ্ডা এবং গরম অনুভব করতে পারে।

জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ময়মনসিংহে (পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ছিল) বর্তমানে বাংলাদেশ। ময়মনসিংহে জন্ম নিলেও জগদীশ চন্দ্র বসুর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবার নাম ছিল ভগবান চন্দ্র বসু যিনি পেশায় একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পেশায় নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে অনেক দিন শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসুর মায়ের নাম ছিলো বামা সুন্দরী দেবী।

জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা অনেক উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ ছিলেন কিন্তু তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা ইংরেজীর চেয়ে বাংলা ভাষাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন যদিও তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবার ইচ্ছাতেই জগদীশ চন্দ্র বসুকে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়।জগদীশ চন্দ্র বসুকে এই বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর একটাই উদ্দেশ্য ছিল তিনি যেন দেশের ভাষা,দেশের সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমের শিক্ষা লাভ করতে পারেন ।নিজের বিজ্ঞানমনা মনকে বিজ্ঞানের আরো কাছে নিয়ে যেতে তিনি গ্রামের স্কুলের পড়ালেখা শেষ করে পাড়ি জমান কলকাতায়।সেখানে তিনি হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন।

এখানে পড়ালেখার সময় জগদীশ চন্দ্র বসু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগী হন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর দিন দিন তার দক্ষতা বাড়তে থাকে। এরপর তিনি ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।ইউজিন ল্যাফন্ট নামক এক ব্যক্তি জগদীশ চন্দ্র বসুকে অনেক সাহস তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।বিজ্ঞান নিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসুর কৌতূহল দিন দিন বাড়তেই থাকে এবং তিনি আরো উচ্চ শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন আর নিজের এই মনবাসনাকে বাস্তবে রুপ দিতে তিনি ভর্তি হন লন্ডনের কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে।কঠোর অধ্যায়নের পর জগদীশ চন্দ্র বসু কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে ন্যাচারাল সাইন্সে ডিগ্রী লাভ করেন।

১৮৮৫ সালেই জগদীশ চন্দ্র বসু কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার দুই বছর পর অবলাদেবীকে বিয়ে করেন।বিয়ের সময় তার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল।জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা অনেক টাকা ঋণ ছিলেন।পরবর্তীতে অবলাদেবী ও জগদীশ চন্দ্র বসু মিলে তার বাবার ঋণ পরিশোধ করেন।

জগদীশ চন্দ্র বসুর কর্মজীবন শুরু হয় ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে। তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসন চলমান ছিল। স্কুল,কলেজসহ সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছিল ইংরেজদের আধিপত্য। ভারতীয় শিক্ষকদের কোন সম্মান দেয়া হতনা এমনকি তাদের খুব কম বেতন দেয়া হত। কলেজে শিক্ষকতা শুরুর পর থেকেই জগদীশ চন্দ্র বসু ইংরেজদের এমন আধিপত্যের বিষয়টি খেয়াল করেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন।

নিজের অবস্থান ঠিক রেখে তিনি এই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন এবং নিজের বেতন নেয়া বন্ধ করে দেন যার ফলে তিনি অর্থনৈতিক সঙ্কটে পরে যান। জগদীশ চন্দ্র বসুর এই প্রতিবাদ দীর্ঘদিন চলার পর ইংরেজ সরকার তাদের দাবি মেনে।

বিজ্ঞান যার ধ্যানে জ্ঞানে সে কি আর গবেষণা না করে থাকতে পারে! জগদীশ চন্দ্র বসু গবেষণা নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অনেকটা সময়। গবেষণার সকল শাখাতেই তিনি ছিলেন সফল। ছোট বেলা থেকেই জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদ জগত নিয়ে অনেক ভাবতেন এমনকি প্রতিদিন বিকেল বেল নদির তীরে গিয়ে পরবেশটাকে অবলোকন করতেন।

ছোট বেলার সেই চিন্তা চেতনা তিনি তার গবেষণায় প্রয়োগ করেন এবং উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং তিনি প্রমান করতে সক্ষম হন যে উদ্ভিদ দেহেও প্রাণ আছে।উদ্ভিদ দেহে প্রাণ আছে এটা তিনি প্রমাণ করেন ক্রেসকোগ্রাফ নামক একটি যন্ত্রের মাধ্যমে।উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য জগদীশ চন্দ্র বসু একটি গাছ এবং একটি বিষাক্ত গ্যাসযুক্ত পাত্র ব্যাবহার করেন। এরপর তিনি গাছটি বিষাক্ত গ্যাসযুক্ত পাত্রে অনেকক্ষণ রেখে দেন এবং খেয়াল করেন যে প্রাণী দেহের মতই গাছের পালস বোঝা যাচ্ছে।

এছাড়া তিনি এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার যেটার মাধ্যমে তার ছাড়াই বার্তা প্রেরণ করা সম্ভব হয়।এছাড়াও তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ অবদান রেখে গেছেন ।

বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয় তাঁর আবিষ্কার তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল।প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম ১৮ মাসে জগদীশচন্দ্র বসু যে সকল গবেষণার কাজ সম্পাদিত করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভূষিত করেছিল ‘ডিএস-সি’ উপাধিতে। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের সম্ভাব্যতা স্বীকৃত হয়েছিল।

জগদীশচন্দ্র বসু স্যার’ উপাধিতে ভূষিত হন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। জগদীশচন্দ্র বসুকে Fellow of Royal Society হিসাবে বেছে নেওয়া হয় ১৯২০ সালে

জগদীশচন্দ্র বসু একাধারে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক ও বটে। তাঁর রচিত ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে আছে তার অমলিন স্বদেশপ্রেম, গভীর দর্শন চিন্তা ও আন্তরিক সাহিত্য প্রীতির সুস্পষ্ট পরিচয়। হতমান ভারতবর্ষের সন্তান হিসেবে তিনি যে পরাধীনতার গ্লানি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাঁর বিজ্ঞান সাধনার পথে সেই পরাধীনতাকে যে প্রবল বাধা সৃষ্টি করেছিল তা তিনি অশ্রুসিক্ত ভাষায় অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভবে বর্ণনা করে গিয়েছিলেন।

অধ্যাপনা বৃত্তি থেকে অবসর গ্রহণ করবার পর পরাধীন ভারতের বিজ্ঞানের গবেষণার দৈন্য দূর করবার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯১৭ সালের ৩০শে নভেম্বর স্থাপন করেছিলেন “বসু বিজ্ঞান মন্দির’। তাঁর জীবনের উপার্জিত সমস্ত অর্থই এই গবেষণা মন্দিরের নির্মাণ ও উপকরণাদি ক্রয়ে ব্যয়িত হয়েছিল। অবশেষে বিজ্ঞানের কক্ষ কক্ষান্তরে বিচরণ করে তাঁর রহস্যপুরীর দুয়ার একে একে উন্মুক্ত উন্মুক্ত করে ভারতের বিপুল সম্ভাবনায় বিজ্ঞান সাধনায় দ্বারোদঘাটন করে ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতমাতার সুসন্তান এই বিশ্ব বিশ্রুত বিজ্ঞান -বীর পরলোক গমন করেন। কিন্তু ভারতের বিজ্ঞান লক্ষ্মীর পদতলে উৎসর্গীকৃত প্রাণ এই মহামনীষী তাঁর উত্তর-সাধকের জন্য বিজ্ঞান সাধনার যে একটি অনুকূল পরিবেশ রচনা করে গিয়েছেন তা ব্যর্থ হয়নি ;তা ব্যর্থ হবার নয়। তাঁর বিজ্ঞানসাধনার পৃষ্ঠতলে বাংলার যেসব তরুণ বিজ্ঞানী ভিড় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ‘জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ,মেঘনাথ সাহা অন্যতম।

১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে।
Facebook Comments Box

Posted ৬:৫১ পিএম | বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২২

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।