| শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট | 287 বার পঠিত
অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার জন্য ছিলেন সুপরিচিতি। সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁর আপোষহীন ন্যায়নীতি ও অসামান্য বাকপটুতার কারণে রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।
এ. কে. ফজলুল হক ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র ছিলেন।
এ. কে. ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন।
সেখান থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রাস পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে।
১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। করেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়।
কথিত আছে তিনি ইংরাজি ভাষায় এম.এ. পড়তে গেলে তাঁর এক সহপাঠী তাঁকে বলেছিলেন মুসলমান শিক্ষার্থীরা অঙ্ক পড়তে ভয় পায়। সে কারণেই তিনি ওই সহপাঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতি নিয়ে অঙ্কে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন ফজলুল হক।
১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন এ. কে. ফজলুল হক। দুবছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন।
১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ব-বাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকুরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে এ. কে. ফজলুল হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন।
চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন এবং এর প্রতিকার করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়, পরবর্তী জীবনে তা তার জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। ১৯০৮ সালে এস.ডি.ও –এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর এনিয়ে বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, ঢাকার চতুর্থ নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন তৈরির কথা ভাবেন।এই চিন্তা থেকেই নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে অংশ গ্রহণ করেন ফজলুল হক। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ।
সেই অর্থে মুসলিম লীগের পথচলার শুরু থেকেই দলটির সঙ্গে ছিলেন তিনি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি ১৯১৩ সালে এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি। ওই একই সময়ে পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।
১৯২৪ সালে ফজলুল হক বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩৫ সালে এ. কে. ফজলুল হক কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।
ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৩০ এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পরপর বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সভাপতিত্বে।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত ১৯৩০-৩১ সালের প্রথম মুসলিম লীগ ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিল। ফজলুল হক ওই বৈঠকে বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবার পর ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল সেখানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং নির্বাচনে অংশ নেন। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন। ২২ থেকে ২৪শে মার্চ তিনদিনের ওই অধিবেশনে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম ‘পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব’ পেশ করেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক।
তাঁর ওই বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাঁকে উপাধি দিয়েছিল শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ। তখন থেকে তিনি শেরে-বাংলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদের দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। এ সময়ে তিনি ‘ঋণ সালিশী বোর্ড’ গঠন করেন, যার ফলে দরিদ্র চাষীরা সুদখোর মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায়।
ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাবার পর ফজলুল হক ঢাকায় চলে যান এবং ১৯৫২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও কার্যকর হবার পর তিনি স্বারষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে করাচি থেকে ঢাকা চলে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই পদে তিনি ছিলেন সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। আটান্ন সালে পাকিস্তানের এক অভ্যূত্থানের পর তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়।
১৯৬২ এর ২৭ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তিনি প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে এ. কে. ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়।
Posted ৪:৫৫ এএম | শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৩
| admin
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।