| রবিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২২ | প্রিন্ট | 126 বার পঠিত
১৮৭১ সাল, শিকাগোর মহা অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয় কয়েক বর্গমাইল এলাকা। সব ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা, পরবর্তী কয়েক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আধুনিক নগর পরিকল্পনার ছোঁয়ায় এসে শিকাগো সিটি বনে যায় বিশ্বের ৫টি বৃহত্তম শহরের একটি।
১৯৭০ এর দশকের কথা। দ্রুত নগরায়নের ধারাবাহিকতায় শিকাগোতে গড়ে ওঠে শত শত গগনচুম্বী অট্টালিকা। এত শত অট্টালিকার মাঝেও একটি ভবনের সামনে এসে বারবার সকলের নজর আটকে যায়। তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি সিয়ারস অ্যান্ড কোং এর কার্যালয়, ১১০ তলা বিশিষ্ট উচুঁ ভবন, নাম সিয়ার্স টাওয়ার।
শুধু শিকাগো সিটিতে নয়, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত; দীর্ঘ ২৫ বছর ভবনটি ছিল পুরো পৃথিবীর উচ্চতম ভবন, মালিকানার রথবদলে তার বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার। আর দুনিয়াময় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই সু-উচ্চ ভবনটির রূপকার ছিলেন একজন বাংলাদেশী স্থপতি! সারা বিশ্বে যার নাম ডাক রয়েছে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন হিসেবে, তিনি ড. ফজলুর রহমান খান।
প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান বিশ্বব্যাপী পরিচিত এফ আর খান নামে। বিশ্ববরেণ্য এই ব্যক্তির জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল, মাদারীপুর জেলার (তৎকালীন ফরিদপুর জেলা) শিবচর থানার ভান্ডারীকান্দি গ্রামে। পিতা খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে গোল্ড মেডেলিস্ট। পেশায় ছিলেন শিক্ষাবিদ।
১৯৪৪ সালে ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন কলকাতার শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, যার বর্তমান নাম বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সংগঠিত সম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ১৯৫০ সালে ঢাকায় ফিরে এসে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্বিদ্যালয় (বুয়েট) নামে সুপরিচিত।
আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী ফজলুর রহমান খান সেখানকার (বুয়েটের) শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হন। ১৯৫২ সালে সরকারী বৃত্তি ও ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বদেশ থেকে অর্ধ পৃথিবী দূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
ড. ফজলুর রহমান খান ১৯৫৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইন থেকে অবকাঠামো প্রকৌশল বা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে তত্ত্বীয় ও ফলিত মেকানিক্সে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমুর-এ যোগদান করেন।
এই প্রতিষ্ঠানে বছরখানেক কাজের অভিজ্ঞতার পর ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্বপদে ফিরে আসেন। ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন করাচি ডেভলপমেন্ট অথরিটিতে। এখানকার নিয়মতান্ত্রিক বেড়াজাল ভেঙ্গে ১৯৬০ সালে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমুরের আমন্ত্রণে কোম্পানির শিকাগো অফিসের পরিচালক পদে যোগদান করেন। স্কিডমুর এর পাশাপাশি আমেরিকার ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে স্থাপত্য বিদ্যায় অধ্যাপনা চালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে এ্যামেরিটাস প্রফেসর উপাধি লাভ করেন।
তিনি দ্বিতীয় দফায় আমেরিকা এসে স্থাপত্য বিদ্যায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন, যা মানব সভ্যতার অগ্রসরে যোগ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা। প্রচলিত সকল পদ্ধতির বাইরে গিয়ে উচু ভবন নির্মাণের সম্পূর্ণ নতুন ও অর্থনৈতিক ভাবে সাশ্রয়ী একটি পদ্ধতি, ট্রাসড্ টিউব স্ট্রাকচার সিস্টেম আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতির ফলে বিশালাকার ভবন নির্মাণ খরচ অতীতের যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে অনেক হ্রাস পায়। তখন হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় সকল আকাশচুম্বী অট্টালিকার নির্মাণ কাজে এফ আর খানের আবিষ্কৃত ট্রাসড্ টিউব স্ট্রাকচার সিস্টেম পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত।
১৯৬০-১৯৭০ সালের মধ্যেই তার নাম ও কাজ দুনিয়াময় বিভিন্ন আলোচ্য মাধ্যমের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালে তার প্রণীত নকশায় একশ তলা বিশিষ্ট জন হ্যানকক সেন্টার সেকালে এটি ছিল উচ্চতার ভিত্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতর ভবন এবং বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ আবাসিক ভবন। ১৯৭৩ সালে তার নির্মিত একশ দশ তলা বিশিষ্ট উঁচু সিয়ার্স টাওয়ার তৎকালীন সর্বোচ্চ উঁচু ভবন টুইন টাওয়ার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে পিছনে ফেলে এই জায়গা নিজে দখল করে নেয়। এটি বর্তমানে আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও পৃথিবীর ১৬ তম সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে বিবেচিত।
সাট-সত্তরের দশকে যখন পশ্চিমা বিশ্বের প্রকৌশলীদের নিকট কম্পিউটার প্রযুক্তি তেমন পরিচিত ছিলনা। এমন একটি সময়ে ফজলুর রহমান খানের হাত ধরেই পথ চলতে শুরু করে কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন বা ক্যাড, যার সাহায্যে শুরু হয় কম্পিউটার ব্যবহার করে ভবন নির্মাণের পূর্বেই নিখুত বিশ্লেষণ।
ড. ফজলুর রহমান খান বহু স্কাইস্ক্র্যাপার্সের নকশা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ওয়ান শেল্স স্কোয়ার, উলিয়াম স্ট্রিট, ওয়ান ম্যাগনিফিসেন্ট মাইল, অন্টারি সেন্টার ইত্যাদি। সুউচ্চ ভবন নির্মাণ ব্যতীত অন্যান্য শাখায় তার সৃষ্টির মধ্যে সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর, ও জেদ্দা বিমান বন্দরে আরবের ঐতিহ্যবাহী বেদুইনদের তাঁবু, আমেরিকার করোনাডোতে অবস্থিত ইউনাইটেড স্টেটস একাডেমি, কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ১৯৮৩ সালে জেদ্দার হাজী টার্মিনাল নির্মাণের সম্মান স্বরুপ মুসলিম স্থাপত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে ‘আগা খান’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ড. ফজলুর রহমান খান বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তথা স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অর্থ যোগানার উদ্দেশ্যে প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে তার নেতৃত্বে একটি ফান্ড গঠিত হয়। এমনকি তিনি ছিলেন পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে মার্কিন সিনেটে যাওয়া প্রথম বাঙালি।
সম্মান ও উপাধি
ড. ফজলুর রহমান খান ১৯৭২ সালে আরবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যালুমনি এওয়ার্ড লাভ করেন এবং একই বছর ‘কন্সট্রাকশনস ম্যান অব দি ইয়ার’ নির্বাচিত হন। এরপর শিকাগোর ওন্টারিও সেন্টারের একটি ফলকে তাকে নিয়ে লেখা হয় ‘ইনোভেশন ফলোজ প্রোগ্রাম’।
১৯৭৩ সালে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স এবং ১৯৮০ সালে লেহাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সম্মানে ভূষিত হন। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডস-এর ‘ম্যান হু সার্ভড দি বেষ্ট ইন্টারেস্ট অব দি কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি’-তে ফজলুর রহমানের নাম এসেছে পাঁচ বার।
১৯৮৭ সালে ইলিনয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফজলুর রহমান খানকে ‘জন পারমার’ সম্মানে ভূষিত করে। সিয়ার্স টাওয়ারের লবিতে নির্মিত হয় এফ. আর খানের ভাস্কর্য। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করে এবং ওই বছর তাঁর স্মরণে ৪ টাকা মূল্যের একটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। তিনি নিজ জীবদ্দশায় অসংখ্য পদক ও সম্মাননা অর্জন করেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন অসংখ্য ব্যক্তিহৃদয়ে। তেমনি মরণোত্তর পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও উপাধি।
বাংলাদেশের মুখ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল করা বাংলার এই কৃতী সন্তান ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ সৌদিআরবের জেদ্দায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ড. ফজলুর রহমান খান চলে গেলেও রয়ে গেছে তার কৃতিত্ব। তিনি বেঁচে আছেন তার কাজের মধ্যে, যা আজও সকলের কাছে দৃশ্যমান। স্থাপত্য বিদ্যায় অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আইনস্টাইন বলা হয়।
Posted ৬:৪৯ পিএম | রবিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২২
| admin
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।