রেমিট্যান্স খাতে ধস নামানোর লক্ষ্যেই জামায়াতপন্থি ব্যাংক কর্মকর্তারা ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে নানা উসকানি ও গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর কতিপয় প্রবাসী নেতা ও সমর্থকের মদদে গুজব ছড়ানোর লক্ষ্যে নানাভাবে অপতৎপরতা চালাচ্ছিলেন ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রেফতার চার কর্মকর্তা।
গ্রেফতার হওয়া ওই ব্যাংক কর্মকর্তারা হলেনÑসোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান রেমিট্যান্স কর্মকর্তা (ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি) মো. মোশাররফ হোসাইন, ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান (ঢাকা-নর্থ) মোহাম্মদ সাঈদ উল্লাহ, এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান শহিদুল্লাহ মজুমদার ও ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস চেয়ারম্যান (সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি) ক্যাপ্টেন (অব.) হাবিবুর রহমান। এ অপকর্মের সঙ্গে আরও কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন গোয়েন্দারা।
গত বুধবার রাতে তাদের গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ বলেছে, রেমিট্যান্স (বৈদেশিক মুদ্রা আয়) ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগাতে বেশকিছু লোক নিয়োগ করেছিলেন গ্রেফতার ব্যক্তিরা। এ চারজনকেই বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিব তাদের কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে একটি চক্র নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আরও বিস্তারিত জানতে তিনি ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
তবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি মেসেজ পাঠানো হলেও তার জবাব দেননি তিনি। তবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেফতার চারজনই জামায়াত-শিবিরের অনুসারী। ব্যাংক খাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে বিদেশ থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তাদের সঙ্গে এই চারজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ধস নামানোর টার্গেট নিয়ে ওই চক্রটি কাজ করে যাচ্ছিল। প্রবাসীরা যাতে বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠান এ জন্য নানা ধরনের প্রচারণাও চালাচ্ছিলেন তারা। এ ছাড়াও চক্রটি ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগাতে বেশ কিছু লোকজন নিয়োগ করে। গোয়েন্দা পুলিশ বিভিন্ন এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পোস্টার সাঁটানো কয়েকজনকে আটক করে। তাদের দেওয়া তথ্য এবং এর আগে গত ৮ জানুয়ারি একই অভিযোগে গ্রেফতার পাঁচজনের কাছ থেকে নানা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতেই ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের ওই চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতার চারজনের মধ্যে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান রেমিট্যান্স কর্মকর্তা মোশাররফ হোসাইনকে মাস্টারমাইন্ড মনে করছেন গোয়েন্দারা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী ব্যাংকে রেমিট্যান্স শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে রেমিট্যান্সে ধস নামাতে দেশি-বিদেশি চক্রের সঙ্গে তার সখ্য অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, গত বুধবার রাতে গ্রেফতার মোশাররফ হোসাইন গত বছরের জুন থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান রেমিট্যান্স কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মোশাররফ হোসাইন ১৯৮৯ সালে ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কথিত আছে, জামায়াত-শিবিরের সক্রিয় নেতা বা কর্মী না হলে এবং দলের নেতাদের সুপারিশ ব্যতীত আগে ইসলামী ব্যাংকে চাকরি হতো না। তবে গত ২-৩ বছরে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার মূল দায়িত্বে আসার পর জামায়াতপন্থি ঊর্ধ্বতন বেশকিছু কর্মকর্তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মোশাররফ হোসাইনকেও ডিএমডির পদ থেকে সরে যেতে হয়। এরপরই তিনি প্রধান রেমিট্যান্স কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংক ছাড়লেও মূলত মোশাররফসহ আরও কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। যেহেতু ইসলামী ব্যাংকে প্রবাসীদের পাঠানো সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে, সে কারণেই এ ব্যাংক এবং রেমিট্যান্সের বিষয়ে গুজব ছড়ানোর কাজটি চালানো হচ্ছিল।
ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোশাররফ হোসাইন সৌদি আরবে রেমিট্যান্স সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রেমিট্যান্স আহরণে বিশেষ পারদর্শিতার কারণে ফরেন রেমিট্যান্স অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ২০১৩ সাল পর্যন্ত একই ব্যাংকের ফরেন রেমিট্যান্স সার্ভিস ডিভিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র (নির্বাহী পরিচালক) মো. মেজবাউল হক সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাংক খাত বা আর্থিক খাতের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে গুজব ঠেকানো বা মনিটরিং করার বিষয়গুলো আমাদের এখতিয়ারে নেই। আমরা এ ধরনের কাজ করি না। আমাদের সে ধরনের বিশেষ কোনো সরঞ্জাম বা কোনো কিছুই নেই। এটি মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখে থাকে। চার ব্যাংক কর্মকর্তার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (ডিবি) তদন্ত করে যা পেয়েছে সে অনুসারেই তারা ব্যবস্থা নেবে