নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট | 130 বার পঠিত
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম নিয়ে অনেক কথা হয়। লেখালেখিও কম হয় না। কিন্তু আজও কোনো কার্যকর সমাধানে আসতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। প্যারেটো রুল বলে একটা ধারণা আছে। সেখানে বলা হয়, ২০ শতাংশ কারণ থেকে ৮০ শতাংশ ফলাফল আসে।
এই লেখার আলাপ সেই ধারণা থেকে। ইন্টারনেটের বড় অংশজুড়ে আছে ভিডিও। তাই গুগল, মেটা ও অ্যামাজনের মতো বড় কনটেন্ট সরবরাহকারীরা তাদের কনটেন্ট সরবরাহ করার নেটওয়ার্কে (সিডিএন) প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, করছে। তৈরি হয়েছে ক্লাউডফ্লেয়ারের মতো কনটেন্ট সরবরাহ, কনটেন্টের নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করার বড় প্রতিষ্ঠান। পুরো ইন্টারনেট জগতের ২০ শতাংশের নিরাপত্তাসেবা এরা একাই দিয়ে থাকে। বিনিয়োগও এসেছে প্রচুর। সবার কাজ একটাই—কীভাবে সবচেয়ে কাছে থেকে একজন গ্রাহককে কনটেন্ট সরবরাহ করা যায়?
ইন্টারনেটের দামের একটা বড় অংশ চলে যায় দেশের বাইরে ইন্টারনেট ট্রানজিট কিনতে গিয়ে। ইন্টারনেট ট্রানজিট হলো ছোট ইন্টারেন্ট সেবা প্রদানকারীকে বড় ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসে গুগল, মেটা, নেটফ্লিক্স ও আকামাই থেকে। কনটেন্ট সরবরাহ ব্যবস্থাপনা একটা জায়গা থেকে করা হয়। একে বলে ‘পয়েন্ট অব প্রেজেন্স’। যদি গুগল ইত্যাদির এই পয়েন্ট বাংলাদেশের ভেতরে থাকত, তাহলে ইন্টারনেটের দাম সর্বনিম্ন এবং গ্রাহক অভিজ্ঞতা সর্বোচ্চ হতো।
বর্তমানে দেশের বাইরের এই কনটেন্ট সরবরাহ করার নেটওয়ার্কের সঙ্গে ব্যক্তিসংযোগ তৈরি করছে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়েগুলো (আইআইজি)। আর এর জন্য বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে তাদের। তাদের অবস্থান ভারত ও সিঙ্গাপুরে। এটা বাড়তি চাপ ফেলছে ইন্টারনেট সেবা প্রদান শিল্পের ওপর। ৫০০ টাকায় মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সরবরাহ করতে চাইলে দেশের বাইরে থেকে কনটেন্ট কিনে সেবা প্রদান করা দুরূহ বটে।
বাংলাদেশে সুলভ মূল্যে, অর্থাৎ দুর্দান্ত ইন্টারনেট সেবা দিতে হলে সাধারণ ইন্টারনেটের চেয়ে ন্যূনতম ৮০: ২০ অনুপাতে কনটেন্ট সরবরাহকারীদের বাংলাদেশের ভেতরে পয়েন্ট অব প্রেজেন্স থাকতে দেওয়া দরকার। এই প্রেজেন্স বাংলাদেশে না থাকায় অনেক বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছি আমরা। সমস্যা কোথায়?
এই সিডিএন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে কিছু আইনি বাধা রয়েছে। ধরা যাক, মেটা বা গুগল বাংলাদেশে তাদের পপের ডেটা সেন্টার খুলল। কিন্তু সেখানে যদি সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে—এমন কিছু কনটেন্ট থাকে, যা আসলে ব্যবহারকারীরা পোস্ট করেছে, তখন কী হবে? সরকার কি সেই ডেটা সেন্টার বন্ধ করে দিতে পারবে? আর যদি বাংলাদেশ সেসব ডেটা সেন্টারকে ‘সিলগালা’ করে দেয়, তাহলে তাদের (গুগল, মেটা ইত্যাদি) বিনিয়োগের কী হবে?
শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। ভারতে চলছে নতুন আইটি নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিতর্কিত কনটেন্ট অপসারণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্টের জন্য দায়ী করা হয় না। এ জন্য বিশ্বের কনটেন্ট সরবরাহকারীরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মূল ডেটা সেন্টার রাখে। তাদের সেই আইনি সুরক্ষা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জন্য এই বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এসব ঝুঁকি থাকায় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে দ্বিধায় পড়ে।
পাশাপাশি গুগলের ক্যাশ সিস্টেম নিয়েও সমস্যা রয়েছে। গুগলের কনটেন্ট সরবরাহ ব্যবস্থাপনার (যেটা ভারত ও সিঙ্গাপুরে আছে) শেষ প্রান্তে থাকে গুগল ক্যাশ, যা সাধারণত বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের কাছে থাকে। ক্যাশ সিস্টেম মানে হচ্ছে, যে কনটেন্টগুলো একবার বাংলাদেশে ঢুকে যায়, সেগুলোকে বারবার ডাউনলোডের জন্য আলাদা পয়সা দিতে হয় না। ফলে এই গুগল ক্যাশগুলো কিছুটা সাশ্রয় করে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ মোতাবেক প্রান্তিক (ছোট) ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের থেকে এই ক্যাশ সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছিল। তাতে গুগল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এ কারণে গুগল বাংলাদেশে নতুন করে প্রয়োজনীয় ক্যাশ সার্ভারগুলো পাঠাতে চাইছে না। এই মুহূর্তে চাহিদার ক্যাশগুলো বাংলাদেশে না পাওয়ার ফলে পূর্বাভাস অনুযায়ী গুগলের এ ধরনের সেবা চাহিদা থেকে ৫০ শতাংশ কম পাওয়া যাবে। এর ফলে খরচ আরও বাড়বে এবং গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ব্যাহত করবে।
শেষ কথা হলো, বাংলাদেশে উন্নত ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হলে শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, আইনি ও নীতিগত পরিবর্তনও প্রয়োজন। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে দেশের মানুষ উন্নত ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা পেতে পারে।
Posted ১১:৫৫ এএম | বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।