মাহে রমজানের আগমনে মুমিনজীবন মুখরিত নতুন জীবনের জয়গানে। আকাশ ফোঁড়ে নেমে আসে রহমতের বারিধারা। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য উন্মুক্ত হয় বেহেশতের দরজা। গুনাহগার বান্দা পায় প্রভুর ক্ষমা ও নৈকট্য অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ। রোজা আমাদের নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনে অনন্য ভূমিকা রাখে।
দেহ-মনের রোজা
রোজা আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উন্নয়নে এক বিশেষ প্রক্রিয়া। সিয়াম সাধনায় শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহারের চেয়ে মনের গতি-প্রকৃতি, কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বই অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজাকে দেহের জাকাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ জন্যই দেহের সব অঙ্গের রোজা রাখতে হবে। সব অঙ্গের পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা হলো রোজা। রমজানে মুখের অশ্লীল কথা থেকে বিরত থাকতে হবে। চোখের গুনাহ থেকে দৃষ্টি হেফাজত করতে হবে। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় গান-বাজনা, খারাপ কথা ও কাজ, পরনিন্দা-গিবত ও অশ্লীল মন্তব্য থেকেও বিরত থাকা জরুরি। নিজের দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হবে। মাহে রমজানে অবৈধ পথে পা বাড়ানো কিংবা হাতের শক্তি দিয়ে যেকোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিশুদ্ধিতা লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, রিপুর তাড়না, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, জুলুম-নির্যাতন ও অসামাজিক দুর্বৃত্তপনা পরিহার করে ধার্মিকতার পথে অগ্রসর হওয়াই রমজান। নিজ অন্তরকে সব ধরনের খারাপ ও মন্দ চিন্তা, হিংসা, কু-ধারণা ও কল্পনা থেকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য লৌকিকতা বা প্রদর্শনের ইচ্ছা পরিহার করে আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়ে ইবাদতে মনোনিবেশ করা উচিত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে।’ (সুরা আ’লা : আয়াত ১৪)
মুত্তাকি হওয়ার উপায়
পবিত্র রমজান মাস মানুষকে একটি রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসে। এ মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানকে শিকলে বাঁধা হয়, যেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মুত্তাকি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না আসে। এ মাসের ইবাদত হাত, মুখ ও অন্তরের গুনাহ থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়। ধৈর্য ও তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। পাপাচার, হিংসা, গিবত, চোগলখুরী থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারলেই তাকওয়া অর্জনে সহায়তা করবে। রমজানে বান্দার সব আমলের সওয়াব বৃদ্ধি করে দেয়। লাইলাতুল কদর দান করে ইবাদতে সব নবীর উম্মতের চেয়ে অধিক সম্মানিত করা হয়। মুত্তাকি হওয়ার জন্যই রমজানে কুরআন নাজিল করা হয়। যেন কুরআন পড়ে জীবন গড়ে মুত্তাকি হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; আশা করা যায় যে, তোমরা তাকওয়া অর্জন করবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
নৈতিক উন্নতি সাধন
রোজা মানুষকে সব অন্যায়-অপরাধ থেকে বিরত রাখে। তাই রোজা অবস্থায় গুনাহ করা মোটেই উচিত নয়। গুনাহ করলে রোজা হালকা (সওয়াব কম) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া রোজার পবিত্রতা রক্ষা করা জরুরি। এ জন্য সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে বান্দার নৈতিক উন্নতি ও আত্মশুদ্ধি অর্জন হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় মিথ্যাচার ও মন্দ কাজ ত্যাগ করেনি তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ যারা গুনাহ করে তাদের রোজা (সওয়াবের হিসেবে) হালকা হয়ে যায়। অবশ্য মানুষের অপরাধ অনুযায়ী রোজা হালকা হয়। যেমন কাউকে কষ্ট দিলে এক ধরনের হালকা, গিবত কিংবা চোখলখুরী করলে একরকম, মিথ্যা, পরনিন্দা খারাপ কথাবার্তা বলা দ্বারা রোজা হালকা হয়। অন্যায় অনুযায়ী রোজা হালকা কিংবা নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্যই রোজা অবস্থায় ঝগড়া বিবাদ থেকে বেঁচে থাকতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রোজা অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল, হট্টগোলে লিপ্ত না হয়। বরং যদি কোনো ব্যক্তি কোনো রোজাদারের সঙ্গে গালাগাল বা মারামারি-কাটাকাটিতে লিপ্ত হতে চায় তবে সে যেন (অনুরূপ আচরণ না করে) বলবে, আমি রোজাদার।’
গুনাহ মাফের উপায়
রমজান গুনাহ ক্ষমা করানোর মাস। বুখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরের সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন আমিন। পরের দুই সিঁড়িতেও পা রেখে বললেন, আমিন। সাহাবিরা আমিন বলার কারণ জানতে চাইলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আমার প্রিয় সাহাবিরা! একটু আগেই জিবরাঈল আমার কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! তিন পোড়া কপালের জন্য এখন আমি বদদোয়া করব, প্রতিটি দোয়া শেষে আপনি আমিন বলবেন। অতঃপর আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, জিবরাইল বলল, বৃদ্ধ মা-বাবাকে পেয়েও যে জান্নাত অর্জন করতে পারল না তার জন্য ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখি, জিবরাঈল বলল, যে আপনার নাম শুনবে কিন্তু দরুদ শরিফ পড়বে না, তার জন্য ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন। আর যে রমজান মাস পাবে কিন্তু নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নিজেকে জান্নাতের উপযোগী মানুষ বানাতে পারবে না, তার জন্যও ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন।’ এ জন্যই যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহ ক্ষমা করাতে পারল না, সে কপাল পোড়া।
ক্ষমা প্রার্থনা
আমরা গুনাহ করতে ভালোবাসি, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময় দয়ালু। গুনাহ ক্ষমা করাতে হলে সেহরি ও ইফতারসহ সব খাবারে হারাম পরিহার করতে হবে। হারাম ভক্ষণে কোনো দোয়াই কবুল হবে না। দুই হাত আল্লাহর দরবারে উঠিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। বিগত দিনের অন্যায়-অপরাধের কথা স্মরণ করে ক্ষমা চাইতে পারা ভালো। মানুষ যত বেশি পাপকাজ করতে থাকে, তার অন্তরে পাপের কালিমা তত বেশি পতিত হয়। এই পাপের মরিচা থেকে আত্মশুদ্ধি তথা অন্তরকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার রাখার একমাত্র পন্থা হলো আল্লাহর জিকির। মানুষ যতই আল্লাহর জিকির-আজকার, ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা পালন করবে, তার অন্তর থেকে ততই পাপ মুছে যাবে এবং সে পাপমুক্ত হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপ মোচন করেন।’ (সুরা শূরা : আয়াত ২৫)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাপকাজ করে তা থেকে তওবা করে, সে ব্যক্তি এমনভাবে নিষ্পাপ হয়ে যায়, যেন সে পাপকাজ করেনি।’ তাই মাহে রমজানে গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। সেহরি ও ইফতারসহ বিশেষ মুহূর্তে অপরাধ ক্ষমা করানোর জন্য চোখের পানি ফেলতে হবে। পাপকর্ম থেকে সর্বদা বেঁচে থাকতে হবে। সঠিক নিয়ত ও বিশুদ্ধভাবে তওবা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৮)