নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 135 বার পঠিত
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪-এ ১০০ বছর বয়সে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু আমার মতো অনেকের মধ্যে স্মৃতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে আমরা যারা ১৯৭০-এর দশকে ছাত্র ছিলাম। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাটানো কার্টারের দিনগুলো নস্টালজিয়া, তিক্ত গণজাগরণ এবং আমেরিকা ও বিশ্ব ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের সাক্ষী।
কার্টার আমার রাজনীতি বা আদর্শকে খুব বেশি প্রভাবিত করেননি। তবে তাঁর এক মেয়াদের জটিল প্রেসিডেন্সির (১৯৭৭-১৯৮১) সময় তিনি আমার মাতৃভূমি ইরানের ইতিহাসের গতি এবং সম্ভবত আমেরিকার ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর সময়েই ইরানের ১৯৭৭-১৯৭৯ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৯-১৯৮১ সালের ইরান দূতাবাস জিম্মি সংকট। ওই সময়েই আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম।
আমি জন্মেছি দক্ষিণ ইরানে। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট ইরান থেকে গিয়ে ফিলাডেলফিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাই। কয়েক সপ্তাহ আগে ফিলাডেলফিয়াতেই প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ও জিমি কার্টারের মধ্যে প্রথম টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি তখনো ভালোভাবে ইংরেজি বুঝতাম না। তাই বিতর্ক পুরোপুরি বুঝে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই বছর আরও দুটি বিতর্ক হয়েছিল। সেগুলো আমার স্মৃতিতে এখন আর স্পষ্টভাবে নেই। তবে মনে আছে যে কে যেন বলেছিলেন—কার্টার ছিলেন একজন বাদামচাষি।
মারা যাওয়া এই কার্টার সম্ভবত তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠবেন তাঁর কর্ম, অপকর্ম এবং বিশেষ করে তাঁর দুঃসাহসিক ঘটনাগুলোর প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত ফলাফলের জন্য।
আমেরিকার সঙ্গে আমার এই প্রথম পরিচয় ছিল মধুর। এই মাধুর্য বেশি দিন টেকেনি। আমার মাতৃভূমিতে বিপ্লবী ঢেউ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে, পেহলভি রাজতন্ত্রকে আয়াতুল্লাহ খোমেনি সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করেন। রাজতন্ত্র উৎখাত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র।
পেহলভি রাজতন্ত্রের পতনের জন্য আজও বহু রাজতন্ত্রবাদী কার্টারকে দায়ী করেন। এমন ভাবা একেবারে অমূলক নয়। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে গুয়াদেলুপ সম্মেলনে কার্টার যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির নেতাদের সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তখন ইরানের পরিস্থিতিও আলোচ্য বিষয় ছিল। যদিও তেমন প্রমাণ নেই, তবু ইরানি রাজতন্ত্রবাদীরা বিশ্বাস করেন যে এই সম্মেলনেই শাহকে দেশত্যাগের সংকেত দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৯ সালের নভেম্বরের সেই শরতে ইরান দূতাবাসে জিম্মি সংকট শুরু হয়। ৫২ জন আমেরিকানকে তেহরানে মার্কিন দূতাবাস থেকে আটক করা হয়। ৪৪৪ দিন ধরে (৪ নভেম্বর ১৯৭৯ থেকে ২০ জানুয়ারি ১৯৮১) তাঁদের জিম্মি করে রাখা হয়। এই সংকট কার্টারের প্রশাসনের শেষ বছরকে পঙ্গু করে দেয়। তিনি পুনর্নির্বাচনে রোনাল্ড রিগানের কাছে পরাজিত হন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির এক বিপজ্জনক অধ্যায়।
জিম্মি সংকটের প্রতিশোধ নিতে কার্টার ইরানি ছাত্রদের ভিসা বাতিল করেন। আমাদের ইমিগ্রেশন পরিষেবায় রিপোর্ট করতে বাধ্য করা হয়। নতুন ভিসা পাওয়া পর্যন্ত আমরা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে আটকে পড়ি।
১৯৮০ সালের এপ্রিলে, কার্টার অপারেশন ‘ইগল ক্ল’ নামে সামরিক মিশনের অনুমোদন দেন। এর লক্ষ্য ছিল তেহরানে আটক জিম্মিদের উদ্ধার করা। তবে এই অভিযান মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়। পাঠানো হেলিকপ্টারগুলোর যান্ত্রিক সমস্যার কারণে মিশন বাতিল করতে হয়। প্রত্যাহারের সময় একটি হেলিকপ্টার ও একটি বিমানের সংঘর্ষে আটজন মার্কিন সেনা নিহত হন। এর পর থেকে দূরের দেশে আমেরিকা সেনা পাঠাতে দ্বিধা করলে বলা হতো ‘ভিয়েতনাম সিনড্রোম’। রিগান প্রেসিডেন্ট হয়ে এসে এই সিনড্রোম কাটানোর জন্য গ্রানাডা আক্রমণের মতো বড় অভিযান শুরু করেন।
কার্টারের পর থেকে আমেরিকান রাজনীতি ক্রমেই ডানপন্থী হয়ে ওঠে। রিগানের নেতৃত্বে নব্য রক্ষণশীলদের উত্থান ঘটে, যা পরে বুশের ‘প্রজেক্ট ফর আ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ এবং ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা মাগা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ৯/১১-এর পর বুশের আমলে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ আমেরিকাকে ‘ভিয়েতনাম সিনড্রোম’ থেকে মুক্ত করে।
আজকের গাজার পরিস্থিতি সেই যুগের ফল। এই পরিবর্তন সম্ভবত কার্টারের সময় শুরু হয়েছিল। তবে এ–ও ঠিক, কার্টারই ইসরায়েলি শাসনকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বর্ণবৈষম্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
কার্টারের শাসনামল একটি যুগান্তকারী সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জিমি কার্টারের উত্তরাধিকার জটিল হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আদর্শবাদ, তাঁর ভুল এবং তাঁর সময়ের আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ চিরকাল ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
Posted ২:০৬ পিএম | বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।