নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট | 125 বার পঠিত
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের প্রাগ্রসর সামষ্টিক অর্থনীতিবিদদের একজন। অনেক দিন কাজ করেছেন আইএমএফে। ছিলেন বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি উচ্চকিত ছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংকিংয়ের অসংগতি নিয়ে। ‘১০টি ব্যাংক লাইফ সাপোর্টে আছে’ বা দেউলিয়া হয়ে গেছে– এ কথা তিনি কেন বললেন, আমি বলতে পারব না।
আলোচ্য ১০টি ব্যাংক যে দৈন্য অবস্থায়, তাতে সন্দেহ নেই। দুয়েকটা ব্যাংকে কিছুটা উন্নতি হলেও বেশির ভাগেরই তারল্য প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টিতে অন্য কিছু ব্যাংক তাদের তারল্য সহায়তা দিলেও অবস্থার খুব উন্নতি হয়নি। পরিণতিতে আমানত ওঠানোর ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিম বাধা। এমনকি অনেক ব্যাংকে ৫ হাজার টাকার ওপর চেক ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যারা সুদমুক্ত ব্যাংকিংয়ের আশ্রয় নিয়েছিলেন বা উচ্চ মুনাফার আশায় ব্যাংকের বাছবিচার করেননি, তারা পড়েছেন বিশেষ সংকটে।
স্বীকার্য, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সরকারকে শুধু সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না; ব্যাংকের গ্রাহক বা আমানতদারের আস্থা অটুট রাখতেও কাজ করতে হবে। ব্যাংক খাতের অস্থিরতার প্রভাব আমানত প্রবাহেই স্পষ্ট; চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমানত না বেড়ে উল্টো প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা কমেছে। ব্যাংক খাতে এভাবে আমানত কমে যাওয়ার নজির নিকট অতীতে দেখা যায়নি। গ্রাহক বা আমানতকারী আস্থা হারিয়ে ফেললে ব্যাংক খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। কেননা, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণদান তহবিলের প্রধান উৎস আমানতকারীর অর্থ। আর আমানতকারীরা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যই অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন।
শ্রেণিবিন্যাস করলে দেখা যাবে, সাধারণ আমানতকারীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতই মোট আমানতের সিংহভাগ। আস্থার সংকট না কাটলে ক্ষুদ্র কিন্তু মোট আমানতে সিংহভাগ অবদান রাখা আমানতকারীকে আকৃষ্ট করা যাবে না। যখন আমানতকারী ব্যাংক থেকে নিজের অর্থ নির্বিঘ্নে তুলতে পারছেন না, তখন তাঁর মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। একজনের ভয়ে অন্য আমানতকারীও সংক্রমিত। যাদের অর্থ তোলা জরুরি নয়, তারাও তুলতে যাচ্ছে। ফলে একসঙ্গে অনেক ব্যাংকে আমানত উত্তোলনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে আমানতকারীর ভয় দূর করতেই হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত। না হলে এ খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতি, অপ্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন, ব্যবস্থাপনায় পরিবার বা গোষ্ঠীর প্রভাবে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণের হার অত্যধিক বেড়ে গেছে। সরকারেরও ব্যাংকনির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে আমানত সংগ্রহ ও প্রবৃদ্ধির হার কোনো কোনো ব্যাংকে ঋণাত্মক। বিধিবদ্ধ নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
এ খাতকে নাজুক পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ ব্যাংকও অনেকাংশে দায়ী। বিগত বছরগুলোয় এ খাতে অনেক অপরাধ ও অনিয়ম চিহ্নিত হলেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল ভূমিকার কারণে এ খাত সংস্কারের উদ্যোগগুলোও ফলপ্রসূ হয়নি।
একদিকে তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসে লাখ লাখ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; অন্যদিকে কালো টাকার অবাধ দৌরাত্ম্যের কারণে নগদ টাকার চাহিদা ছিল অস্বাভাবিক বেশি, যা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যুকৃত নোট বাড়িয়েছে। আবার ইস্যুকৃত নোটের মোট মূল্যমানের ৯৫ শতাংশই ব্যাংক খাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের বাইরে থাকা অর্থের হার ক্রমশ কমছে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিকের কাছাকাছি যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৯ সালে। সে সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়; ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। যদিও খাত-বিশ্লেষকরা বলছেন, এটিই খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র নয়। লুকানো খেলাপি ঋণ বরং এর চেয়ে অনেক বেশি। অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকার মধ্যে।
আমরা জানি, যে দেশের অর্থনীতি যত সুসংহত, সে দেশে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ব্যাংকের সংখ্যা তত কম। আমরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাই, অর্থনীতির আকার বিবেচনায় সেসব দেশে স্থানীয় ব্যাংকের সংখ্যা বাড়েনি। বরং সেখানে বিদেশি ব্যাংকগুলোর আকর্ষণ বাড়ছে। যেমন– থাইল্যান্ডের জিডিপির আকার ছাড়িয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেখানে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা ১৮। অথচ থাইল্যান্ডে বিদেশি ৪৫টি ব্যাংক শাখা খুলেছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও জাতীয়ভিত্তিক ব্যাংকের সংখ্যা আমাদের দেশের চেয়ে কম: ১২টি সরকারি ও ২২টি বেসরকারি। তবে ভারতে অঞ্চলভিত্তিক ব্যাংক ৪৩টি এবং ৪৬টি বিদেশি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কিন্তু এসব দেশের তুলনায় ব্যাংক খাতে বাংলাদেশের চিত্র পুরো উল্টো। বর্তমানে দেশে তপশিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৬২। এর মধ্যে বিদেশি ব্যাংক ৯টি, তার মধ্যে বৈশ্বিক ব্যাংক দুটি। তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংকসহ দেশে মোট ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে। একটি ডিজিটাল কমার্শিয়াল ব্যাংক লাইসেন্স পেয়েছে। বাকি ৪৩টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী বিবেচনায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে ব্যাংক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শীর্ষ পদগুলোয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিচালনা পর্ষদে সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেড়ে যায়। ফলে ব্যাংক খাতে অস্থিরতার পাশাপাশি অনাদায়ী ঋণ, খেলাপি ঋণ ও ঋণ পুনঃতপশিলীকরণ বেড়েছে। ব্যাংক খাতের এ নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে কোনো বিদেশি ব্যাংকও দেশে আসেনি। আশির দশকে যেসব বিদেশি ব্যাংক দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করত, তারাও নিজেদের অনেকটা গুটিয়ে নেয়।
বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও নিয়মনীতি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নররা। গ্রাহকের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে নোট ছাপানো, সরকারকে ঋণ দেওয়াসহ একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে থাকেন। ফলে পুরো ব্যাংক খাত নাজুক হয়ে পড়ে।
সন্দেহ নেই, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতসহ নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ আরও সুদৃঢ় করতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এ খাতে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। গ্রাহক বা আমানতকারীদের মধ্যে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে মন্দ ঋণ আদায়ে আইন ও আদালতকে সক্ষম করার পাশাপাশি ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণ, ন্যূনতম মূলধনের আকার বৃদ্ধি, বেশি সংখ্যক স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ ও তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। ঋণের বিপরীতে জামানত ও সহ-জামানত বৃদ্ধি এবং এগুলোর সংজ্ঞা পরিবর্তন, আমানত ও ঋণ সর্বক্ষেত্রে সেবা-পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। বাণিজ্যিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মানবসম্পদের দক্ষতা ও বহুবিধ উপায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টি ভুললে চলবে না।
Posted ২:১৭ পিএম | সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।