নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 113 বার পঠিত
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৪৩তম বিসিএসে একবার গেজেটভুক্ত হয়েও পরে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় বাদ পড়া ২২৭ প্রার্থীকে চাকরি ফেরত পেতে পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে হবে, সরকার ২২৭ চাকরিপ্রার্থীর প্রতি খুবই দয়া দেখিয়েছে। কিন্তু তাঁরা তো দয়া চান না, ন্যায়বিচার চান।
এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো গেজেটভুক্ত হওয়ার পর তাঁদের নাম বাদ দেওয়ার এখতিয়ার কি সরকারের আছে? তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনো ফৌজদারি মামলা ছিল? কিংবা কোনো মামলায় কি তাঁদের শাস্তি হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, যাঁদের নাম একবার গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, সরকার তাঁদের কাউকে বাদ দিতে পারে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিটি আপত্তিকর ও শর্তযুক্ত। এতে বলা হয়, ‘ইতিমধ্যে সাময়িকভাবে নিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত ২২৭ জনের মধ্যে যে কেউ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে তা গ্রহণ করা হচ্ছে। পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত আছে।’
প্রথম দফার প্রজ্ঞাপনে নাম থাকায় অনেকে পুরোনো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন সরকারি চাকরির তালিকা থেকেও তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে কোথায় যাবেন?
এ কলাম লেখার সময় আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যাঁরা নিয়োগ পাননি, তাঁদের বিষণ্ন চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি ‘বিসিএস উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের আহাজারি’। সেবার চাকরি না পাওয়া ৮৪ জনের কথা লিখেছিলাম। এবারের সংখ্যাটি ২২৭। এটাই হলো গণতান্ত্রিক শাসনে উত্তরণ। সে সময় কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী প্রথম আলো অফিসে এসে তাঁদের করুণ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করুন। আমরা অন্য চাকরি না নিয়ে বিসিএস পাস করে কি অন্যায় করেছি? সরকার চাকরি দেওয়ার বদলে এখন আমাদের “দেশদ্রোহী” হিসেবে চিহ্নিত করছে। এত বড় অন্যায় কি মেনে নেওয়া যায়?’ এবারেও টেলিফোনে অনেকে তাঁদের দুঃখ ও বেদনার কথা জানিয়েছেন।
সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত ঘোষণা করল কে? চাকরিপ্রার্থীরা নিজেরা পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে নিজেদের উপযুক্ত ঘোষণা করেননি। ১৫ অক্টোবরের ঘোষণাটিও স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি। এসেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের পক্ষ থেকে। পুনর্বিবেচনার আবেদনপত্র আহ্বানের আগে তো সরকারকে স্বীকার করতে হবে, গেজেটভুক্ত হওয়ার তালিকা থেকে কারও নাম বাদ দেওয়াটা ন্যায়সংগত হয়নি।
২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এরপর আবেদন, প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ৪৩তম বিসিএস থেকে ২ হাজার ১৬৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে গত বছরের ১৫ অক্টোবর ২ হাজার ৬৪ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গেজেট প্রকাশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই হয়েছে। অতএব, এ কথা বলার সুযোগ নেই যে যাঁরা বাদ পড়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের অন্যায়ভাবে তালিকাভুক্ত করেছিল। এটা ছিল প্রথম প্রজ্ঞাপন। দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন এল ৩০ ডিসেম্বর। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বিবেচনায় সাময়িকভাবে অনুপযুক্ত ২২৭ জনসহ মোট ২৬৭ জনকে বাদ দিয়ে ১ হাজার ৮৯৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলো।
সরকারের এ সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বাদ পড়া ২৬৭ জনের মধ্যে প্রায় ২০০ জন বুধবার সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন। পরে জনপ্রশাসনসচিবের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার ভিত্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বাদ পড়া ২২৭ প্রার্থীকে পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যাঁরা অংশ নেননি, তাঁদের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু অন্যদের বাদ দেওয়া হলো কিসের ভিত্তিতে? তাঁরা কি সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক? যদি হয়েও থাকেন, তাহলে এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণকেই বৈধতা দেওয়া হলো। মানে আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী এবং বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী কোনো কর্মকর্তা সরকারি চাকরি করতে পারবেন না। যাঁরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা কেউ আওয়ামী লীগপন্থী বা বিরোধী হিসেবে নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।
আরও জানা যাচ্ছে, বাদ পড়া প্রার্থীদের মধ্যে ৭১ জন, অর্থাৎ ৪২ দশমিক ২৬ শতাংশ হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তাঁদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। গণতান্ত্রিক নাগরিক কমিটির বিবৃতিতে অন্তত দুজনের নাম উঠে এসেছে—সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা কৃষ্ণ বর্মণ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা শিপন দে।
সর্বশেষ সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেক সংখ্যালঘু প্রার্থীও আছেন। তবে বাদ পড়া সংখ্যাটি উদ্বেগজনকই বটে। এটির মাধ্যমে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আওয়ামী লীগের ট্যাগ বসিয়ে এসব সংখ্যালঘুকেও বাদ দেওয়া হলো কি না।
আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী না হওয়ার কারণে ২৮তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত পিএসসির সুপারিশ করা অনেক প্রার্থী নিয়োগবঞ্চিত হয়েছিলেন। এই বঞ্চিতদের মধ্য থেকে ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু তারা সাবেক সরকারের একটি অন্যায়ের প্রতিকার করার পাশাপাশি যে আরেকটি অন্যায় করল, সেটা কোনোভাবে মানা যায় না।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়ার মন্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে, জেল খাটলে বা দাগি সন্ত্রাসী হলে পুলিশ রেকর্ড উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেবে। প্রতারণা করে চাকরি নিলে সেটাও এই বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু এ-জাতীয় অপরাধ ছাড়া অন্য কোনো বিবেচনায় বা রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে বাদ দেওয়া যায় না। কিন্তু এটি অতীতেও হয়েছে, বর্তমানেও হয়েছে। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়, এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’
আওয়ামী লীগ আমলে হাইকোর্ট ৮৪ জন বিসিএস উত্তীর্ণকে নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়ার পরও তাঁরা চাকরি ফিরে পাননি। সরকার আপিল করে সেটি ঠেকিয়ে রেখেছিল। এবার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেটি যেন কোনোভাবেই লোকদেখানো অর্থে না হয়। একেবারেই ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ নেই এবং পরীক্ষার কোনো ধাপে কারও সুপারিশ না থাকলে, কোনো অনৈতিক বা বিধিবহির্ভূত সুযোগ–সুবিধাপ্রাপ্ত না হলে বাদ পড়াদের গেজেটভুক্ত করা হোক। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা যেন অতীতের বৈষম্যমূলক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তির কারণে বিফলে না যায়।
Posted ১১:২০ এএম | শনিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।