শুক্রবার ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

প্রতিসমতা

  |   মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   16 বার পঠিত

লেখক: এন এস এম মঈনুল হাসান সজল

 


১##

#

সারাদিনের ব্যাস্তো চোখের কাছে ঢাকার সকালটা খুব অচেনা। খুব শান্ত আর স্থির। শহরের সকালটা এ নাগরিক জীবনে
একটু অন্যরকম সুন্দর। জীবনের প্রতিফলন, ঘুর্নন, আহরন খুব একটা দৃশ্যমান না।

হেমন্তদিনের সকালে কুয়াশা থাকলেও সূর্যের দেখা মেলে ৬টার আশপাশেই। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। তবে রাস্তা-ঘাটফাঁকা। সকালে এই হাটার সময়টা খুব বিচিত্র দর্শন। প্রতিদিনকার রুটিন মাফিক জীবন চর্চায় এইটুকু নিজের সময় ভাবে মুক্ত। সে জীবনকে দেখে এই সময়টুকুতে। সারাদিনের পারিবারিক, সামাজিক দ্বায়িত্ব আর চাপের ভার নেয়ার শক্তি সে  অর্জন করে এই সময়টুকুতেই। বাড়ির আশে পাশেই হাটেন। খুব বেশী দুরে যান না বা বলা যায় সিমানা ছাড়ান না। সেটা মুক্ত’র শ্রেনীর মানুষের সাদ্ধের বাইরেও বটে। শ্রেনীবৈষম্যের এই সমাজ ব্যবস্থায় মুক্তদের জীবনটা সরলরেখায় ভাজ করলে দুটি অংশ পরস্পর মিলে যাবে। জীবনটা যতটাই ঘুরানো হোক বা অবস্থান পরিবর্তন হোক আদি রূপ হাড়ায় না। তারপরও। 


কাল শেষ রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। শীতের আগমনী বৃষ্টি। রাস্তায় কোথাও কোথাও হালকা পানি জমে আছে। তাও ভাল,
রাস্তাটা চিটচিটে হয়নি। ধূলাটাও মরেছে। উন্নয়ন চলছে যে চারিধারে। সকালে হাটাটা কিছুটা সুখের হলো। 


মুক্তর রাড়ি ওপারে ফুটপাতে একটি পলিথিনের ঘর। বাহিরে দাড়িয়েই ভিতরে জীবন দৃশ্যমান। সল্প বয়স্ক এক লোক
ঘুমাচ্ছে, একটা ছোট বাচ্চাকে জরিয়ে। পরম মমতা আর ভালবাসার বন্ধন। একটু আড়ালে শোয়া নারীর পা দেখা যাচ্ছে। সংগ্রামি সংসার। ওরাও বেশ আছে। কখনো কখনো মন খুলে হয়ত হাসে। 


হঠাৎ পানির ছিটা আসতেই মুক্তর ধ্যান ভাংলো। বিরক্তও হলো বেশ। তাকাতেই চোখে পরল, ড্রাইভার গাড়ি ধুচ্ছে। কোন
প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে সে তার কাজ করে যাচ্ছে। মুক্ত কিছু না বলে এগিয়ে গেল। 


রাস্তার পাশে চায়ের দোকান। দোকানী দোকান খুলছে। মুক্ত খাবার পানি আছে কিনা জানতে চাইলে পাশের মাঠের কল
দেখিয়ে দিল। মাঠের কোনায় বয়স্ক কিছু লোকের ব্যামের চেষ্টা। আর মাঠ জুড়ে চলছে ফুটবল খেলা। মাঠে বেশ কাদা।
কাদা মাটিতে মাখামাখি সকল খেলোয়ার। কিছু দর্শকও জুটেছে চারদিকে। মধ্যবয়স্ক এক লোক রেফারিং ও কোচিং দুটোর দ্বায়িত্বই পালন করছে। খেলোয়াররা কিশোর থেকে যুবক মিশ্রনে। একজনের ভুল শট এসে মুক্তর গায়ে। কলে হাত লাগিয়ে পানি খাবার চেষ্টা এখন গোসলের উপক্রম। দুর থেকে রেফারী কাম কোচার দুঃখ প্রকাশের ভংগিমায় এগিয়ে এলেন। মুক্ত বলটি হাতে তুলে নিল। ফুটবলটির দিকে তাকিয়ে মুক্তর কিছুটা অসস্তি বোধ করল। ফুটবলেরর সাথে তার এক গাঢ় সম্পর্ক। রেফারী কাম কোচার কাছে এসে বলে উঠল-


সরি,ভাই। বলটা দিবেন। কোন কথা না বাড়িয়ে বলটা লোকটির হাতে তুলে দিলেন। সাথে মৃদু হাসি। রেফারী কাম কোচার কিছু অপরাধির কন্ঠেই বলল- ধন্যবাদ ভাই। ভাই সরি। লাগেনি তো আপনার? মুক্ত বিনয়ী হয়ে বলল- না না। ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। মুক্ত হাটা শুরু করে দিল।


মুক্ত পথে একটি খেলনার দোকানে ঢুকলেন। একটি বল হাতে তুলে নিলেন।
মুক্ত –         এটার দাম কত? 
দোকানী –     ৫৫০ টাকা। 
মুক্ত –         হুম। আচ্ছা দিন।
মুক্ত টাকা পরিশোধ করে। এবার বাসার দিকে ফিরে।

২##

#

মুক্ত বাসার গেটে ঢুকতে গিয়ে পলিথিনের ঘরটির দিকে আবার তাকায়। লোকটি এখনও ঘুমাচ্ছে। শিশুটি খেলছে। পাশেই মহিলা কিছু একটা রান্নার চেষ্টা করছে। কয়েকটা ইট দিয়ে তৈরী চুলা। সেখানে নানা রকম শুকনো জিনিস পুড়িয়ে হচ্ছে আগুন। সেই আগুনে রান্না। শিশুটি হঠাৎ মুক্তর দিকে তাকায়। খুব মায়াবি চোখ। কিছু হাপুর দিয়ে এগিয়ে আশার চেষ্টা করতেই ওর মা রান্না ছেড়ে কোলে তুলে নেয়। মুক্ত হাতের ফুটবলটির দিকে দেখে। মনে মনে ভাবে, হয়ত বলটির জন্যই তার আগ্রহ ছিল। মুক্ত সময় নষ্ট না করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়।
৩##

#

মুক্তর এক মাত্র ছেলে অক্ষর। দশ বছর আগে অক্ষর মুক্তকে নতুন করে চিনিয়েছে। সে এখন ফোরে পরে। অক্ষর ঘুমাচ্ছে। মুক্ত ঘরে ঢুকে অক্ষরকে দেখে। কিছুটা মাথায় হাত বুলিয়ে মুক্ত- অক্ষর বাবা উঠো, স্কুলে যেতে হবে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুক্ত ফুটবলটা অক্ষরে মাথার কাছে রাখে বেড়িয়ে যায়।


রান্না ঘর কাজ করছে মুনা। মুনা মুক্তর স্ত্রী। বিয়ের বয়স প্রায় চৌদ্দ। মুক্তর সাথে একই সাথে পড়েছে। মস্টার্স শেষ করে
দুজন বুঝতে পেরেছে তাদের বন্ধুত্বের আড়ালে প্রেমটা লুকানো ছিল। যদিও মুক্তকে আগে চাকরীর চেষ্টাই করতে হয়েছে। স্বামী হাড়া মাকে একটু ছুটি দেয়াটা জরুরী ছিল। বাংলার ছাত্র হবার সুবাদে চাকরী পাওয়াটা ছিল কঠিন। অন্য দিকে মুনার বিত্তবান বাবা মেয়ে বুড়িয়ে যেতে দিতে পারছিলেন না। সামাজিক খুব কমন গল্পের পরেও মুনার বাবা মুক্তকে পছন্দ করতেন। মুক্ত বরাবরই খুব সাদামাঠা এবং সততাটা বোঝা যায়। মুনার বাবা বিদেশ থাকতেন। পয়সাও কামিয়েছেন বেশ। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও, মুক্ত আর মুনার একটা বিষয় চরম মিল। সেটা হলো, দুজনই মায়ের শাসনে বেড়ে উঠেছে। মুক্তর চাকরীর জন্য পরবর্তিতে এগিয়ে আগে সহপাঠী বন্ধু বিশ্বাস। 


মুনা পড়ালেখা শেষ করলেও সংসার গোছানোতেই তার সাচ্ছন্দ। মুক্তও বাধা দেয়নি। অবশ্য মুনার সাথে মুক্তর বড় একটা ফাড়াক আছে জীবন চাহিদার। 

মুনা রান্না ঘড়ে সেন্ডউইচ বানাচ্ছে। অক্ষরের স্কুলের টিপিন। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলে আর সময় চাহিদা মেটাতে।
জলের শব্দ। জলের শব্দ ছাপিয়ে মুক্তর কন্ঠ।

মুক্ত –      মুনা জলদি অক্ষরকে তৈরি কর – হাতে সময় নেই – নয়তো তোমাকেই স্কুলে নিতে হবে।
মুনা কিছুটা চিৎকার করেই
মুনা- সব আমিই করবো। আছি তো।
অক্ষর এক হাতে চোখ কচলাচ্ছে আর অন্য বলটি হাতে নিয়ে মায়ের কাছে আসে। 
অক্ষর –   বাবা বল এনেছে। এটা আমি স্কলে নিয়ে যাবো। 
মুনা –     বল? স্কুলে? মাঠ কোথায়? আর ঘরে তুমি একদম খেলবে না। ফার্নিচর ভাঙ্গবে কিন্তু। 
অক্ষর –   আচ্ছা। 
মুনা –     যাও ব্রাশ করে নাও। 

অক্ষর চলে যায়। মুনা কাল রাতের থালাবাটি ধোয়ার চেষ্টা করে।

মুনা- বুয়া টাও আসে না সময় মত। সব কাজ আমিই করে দিবো।

স্যান্ডুজ মেকারে ধোয়া মুনার নাকে লাগে। তাড়াতাড়ি খুলে দেখে বেশ খানেকটা পুড়ে গেছে।এবার মুনা খুব বিরক্ত কি
করবে বুঝে পাচ্ছে না। কারন তাকে আবার বানাতে হবে।
মুনা –    বল কিনেছে। ছেলেটা কতদিন যাবৎ একটা টেবের কথা বলছে, সে ফুটবল নিয়ে এসেছে।
মুক্ত গোসল সেরে বের হয়ে উকি মেরে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু সাহস করে সামনে আগায় না। অফিস যাবার জন্য প্রস্তুতি
নিতে থাকে। আজ গাড়ী আসার কথা। অফিস যাবার আগে সাইড দেখে যেতে হবে। মূলত বিশ্বাস সাহেবের ব্যাবসা জমি
আর বাড়ীর দালালী। কর্পোরেড যুগে কনসট্রাকশন বিজনেশ বেশ। মুক্ত ফিরোজের নাম্বারটা ফোনে ট্রাই করে। নাম্বার বন্ধ।
ফিরোজ বিশ্বাস সাহেবের ড্রাইভার। 

৪##

#

ওদিকে ড্রাইভার ফিরোজ গল্প জুটিয়েছে বশির মোল্লার সাথে। বশির মোল্লা কাজ করে বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠানের জন্য। ব্রোকার সেলার ডিলিংসটা তার মাধ্যমেই হয়। কাউকে সরাতে হলেও বশিরই ভরসা। বশির আর ফিরোজ গাড়ীতে বসা। ফিরোজ সিটে বসে পা তুলে দিয়েছে ডেক্স বোর্ডের উপরে। বশির পাশের সিট ভেঙ্গে আধা শোয়া।

বশির মোল্লা –    কি? তোমার স্যার তো নতুন গাড়িটা ভালই কিনছে।
ফিরোজ –       হ! আমদানি ভালো। শখও বড়। 
বশির –           তোমার আমদানির কি অবস্থা? 
ফিরোজ-   চল চা খাইয়া আসি।
দুজন গাড়ি থেকে বের হয়ে হাটা শুরু করে। এক চাওয়ালাকে পেয়েও যায়। দোকানীকে চায়েরর ওয়াডার দেয় বশীর।
ফিরোজ –        আর! এই নতুন গাড়িটা কুপা। আগের পুরোনো গাড়িটা থাকতে আমার দিন কাল ভালো ছিল।
বশির –           হুম বুচ্ছি! 
চাওয়ালা দুজনকেই চা দেয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে


বশির – তোমার জন্য ভালো কিছু একটা করতে হইব। দেখি কি করা যায়। মুক্ত সাব নামেনা কেন?
ফিরোজ-  আমার নাম্বার ব্ন্ধ।
বশির – কেন?
ফিরোজ- সাইডে যাইবো, গাড়ী লাগবো কেন? থাকে ভাড়া বাসায়। আবার ভাব। 
বশির-  হু বুচ্ছি।


একটি এক হাজার টাকার নোট চাওয়ালাকে দেয় বশির।


বশির –           এই আমাদের হইল কত? 
চাওয়ালা –       এত বড় নোট ভাঙতি নাই।
বশির –          আমার খরচ তো বেশি এক হাজার টাকা নিয়ে বের হলে রাত পর্যন্ত থাকে না। তুমি মিয়া কি ব্যাবসা করো?
ভাঙতি রাখ না কেন?

চাওয়ালা –        যখনই আপনি আসেন তখনই এত্ত বড় দেইখা নোট দেন। 
বশির লজ্জিত হলেও নিজেকে সামলে নেন।
ফিরোজ –        হ বুচ্ছি। সকাল বেলা আমার অনেক ভালই করছেন। 

ফিরোজ চাওয়ালাকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ফোনটা খুলল। মেজাজ তার খুবই খারাপ। 

৫##

#

মুনা অক্ষরকে নিয়ে স্কুলের জন্য বের হয়েছে। গেট দিয়ে বের হতেই পলিথিন ঠেলে বেড়িয়ে আসে শিশুটি। নিশ্চয়তা আরঅনিশ্চয়তার অনিশ্চিত সংগ্রাম। মুনা অক্ষরকে নিয়ে স্টপেজের দিকে হাটে। একটু দূরেই বাস স্টপেজ। 


অক্ষর – মম, ঐ ছেলেটি দেখ দেখ-
মুনা – বস্তির ছেলে- ওকে দেখতে হবে না। 
অক্ষর-  মম কেন? 
মুনা-     এতকিছু বুঝতে হবে না। চলো বাসে উঠতে হবে- 


বাসে উঠার চেষ্টা করে- কিন্তু পারছে না। পথশিশুটি তাকিয়ে দেখে। পরের বাসটি আসে। চেষ্টা করেও- উঠতে পারে না।
প্রচন্ড ভীড়। বাসে ওঠা আর একটি সিট দখল এ শহরের নাগরিকদের জীবনে দিনের সবচেয়ে বড় জয়। এ জয় কেউ যেন হারতে চায় না। 

পথশিশুটি ততক্ষনে ওদের কাছে এগিয়ে এসেছে। অক্ষরের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে দেখে। মুনা অক্ষরকে দূরে
সরিয়ে নেয়। তৃতীয় বাসটি আসে। অক্ষরকে বাসে তুলে মুনা কোন রকমে পাদানিতে উঠে দাঁড়ায়। পথশিশুটি তাকিয়ে
ওদের এগিয়ে যাওয়া দেখে।


বাসে মানুষের ভিড়ে অক্ষর অসহায় বোধ করছে। রাস্তায় প্রচন্ড যানজট। অনুপায় হয়ে বাস থেকে নেমে মুনা অক্ষরকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। 
৬##

#

বিশ্বাসের অফিসটা বেশ। কিছু দিন আগে রিনুভেশন করেছে। টাকা উপার্জন আর খরচের পাল্লা বিশ্বাসের বেশ। আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েইতার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান।  

লম্বা অফিসটাতে একদম শেষ মাথার দু কোনায় দুটি কাচে ঘেরা রুম। একটিতে বসে বিশ্বাস আর অন্যটিতে মুক্ত।
বিশ্বাস আজ খুব তাড়াতড়ি অফিস ঢুকেছে। অফিস ঢুকতেই সব দাড়িয়ে। একমাত্র একাউন্ডস ম্যানেজার রফিক দৌড়ে। সে দৌড়ে আসবেন এবং ব্যাগটি নিয়ে রুমে দিয়ে আসবেন। এ তার প্রতিদিনের চর্চা।


বিশ্বাস-   কি বিলটা এখনো রেডি হয় নি? 
একাউন্টস- স্যার কাজের চাপ। 
বিশ্বাস-   আপনাকে কি বসিয়ে বেতন দিব। 
একাউন্টস-   স্যার কাল অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছি। 
বিশ্বাস –   শুনেন ৬৯ (ঘ)দের  এ কথা বলতে নেই। 
একাউন্টস-   জি 

বিশ্বাস-   নন্দীনি পড়েছেন। 
একাউন্টস-  জি না। 
বিশ্বাস-   বেশ করেছেন। 

ততসময়ে তারা রুমে পৌছে। বিশ্বাস বিষয়টি ইনজয় করে। 

বিশ্বাস: ব্যাগটি রেখে আপনি জান। 

রফিক বেরিয়ে যায়। বিশ্বাস মুক্তকে ফোন করার চেষ্টা করে।
৭##

#

মুনা অক্ষরকে নিয়ে স্কুলের গেটে পৌঁছে। দুজনই ঘামে ভিজে অস্থির।


মুনা : স্কুল থেকে কোথাও যাবে না। আমি এসে নিয়ে যাব।

অক্ষর মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। 

সহপাঠি রিংকু গাড়ী থেকে নেমে অক্ষরের ডাকে।

রিংকু : হাই অক্ষর!
অক্ষর খুব মন মরা ভাবেই হাত নাড়ায়। মুনার চোখ বিষয়টি এড়ায় না।
মুনা: তোমার ধ্রুত ক্লাসে যাও। দেরী হয়ে যাচ্ছে।

দুজনেই গেটের ভিতর চলে গেলে মুনা চলে আসে।   

৮##

#

মুক্ত অফিস রুমে বসে কম্পিউটারে ফেসবুকে ব্রাউজ করছে। বিশ্বাস সামনে বসা। দুই বন্ধুর কাজের সাথে আড্ডাটা
এভাবেই চলে। বিশ্বাস হঠাৎ করে শেয়ার বাজারের প্রশংগ তুললো। মুক্ত পেইজ পরিবর্তন করে শেয়ার বাজার এর পেইজ খোলে।  

বিশ্বাস: দরপতন আর দরপতন।
মুক্ত: আমি আসলে শেয়ার বাজেরে আগ্রহ পাইনা। তোর কথায় যা ছিল লক করে দিলাম।
বিশ্বাস:      বাজারের পতন দেখে হতাশ হলে চলবে। সাহস রাখতে হবে। পুরুষরা খেলবে।
মুক্ত : তুইতো ২০০৮ সালে জোর করে শেয়ার বাজারের এই অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিলি আমাকে।
বিশ্বাস: এদিকে যে ফ্লাট বিক্রিতে দরপতন। সেটাও তো মনে রাকতে হবে।
মুক্ত: আমি তো লসের কথা তুললেই তুই এদিক ওদিক ঘুরিস।
বিশ্বাস : বন্ধু। বন্ধুর মত আচরন কর। মানুষের মত করিছ না। 
মুক্ত :   মানে কি? 

বিশ্বাস :   দেখ, বন্ধুত্বের বিভিন্ন রং হয়। যেভাবেই হোক যে কোন পরিস্থিতিতে সে অস্বীকৃতি জানায় না। এ যুগের মানুষ
বিবর্ন।  পাত্রের রং নেয়। স্বার্থই সর্বস্ব।
মুক্ত   :   বুঝলাম কিন্তু আমার তো চাহিদার সাথে আমদানির সম্পর্ক হারাচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তা । 
বিশ্বাস : বন্ধু অনিশ্চয়তার মধ্যেই এতো বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। বিজনেস সবসময়ই খেলা। কখনও নামবে কখনো
উঠবে। হতাশ হলে চলবে। রাজনীতি আর সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুক্ত : হু-
বিশ্বাস :   : রূপগঞ্জ প্রজেক্টের খবর কি?
মুক্ত : বশির মোল্লা দেখছে। ডিটেইল খবর দিবে আজ।
বিশ্বাস   : প্রয়োজনে তোকে একা হ্যান্ডেল করতে হবে। জমিটা আমাদের চাই।
মুক্ত : হু-

বিশ্বাস বের হয়ে যায়। মুক্ত শেয়ার বাজারের পেইজ পরিবর্তন করে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবছে, অক্ষরকে নিয়ে সময় মত পৌছাল কিনা। কারন একদিন দেরী হওয়া মানে অফিস ম্যানেজ করে হাজিরা দিতে যেতে হবে নিজেকেই।

৯##

#

এ যুগে ক্লাস রুমগুলো বেশ কর্পোরেট হয়ে উঠেছে। সেন্ট্রাল এসি, ওয়েল ফার্নিষ্ট, টিচারদদের ড্রেশ, স্টুডেন্টদের ড্রেশ। সাথে নানা রকম ডিসিপ্লিন। আর ডিসিপ্লিন ব্রেকে আছে ফাইন। অক্ষরের স্কুলও ব্যাতিক্রম না। টিচারের রোল কল করতে করতে অক্ষর ক্লাসের দরজায়। সাথে সহপাটি রিংকু।

টিচার : ও মাই গড। ইউ আর লেইট? হাউ ক্যান?

অক্ষর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। রিংকুটা তুলনা মুলক চন্চল।

রিংকু : টিচার, ওদের গাড়ী নেই তো তাই-
টিচার : ওহ্! গাড়ী নেই!
টিচার নিজে নিজে আওরাচ্ছে, 
টিচার: গাড়ী ছাড়া এ যুগে ভদ্রলোকরা চলে নাকি! অক্ষর তোমার রেফারেন্স জানতে হবে। কিন্তু রিংকু দেরী হলো কেন?
রিংকু: টিচার, আর হবে না।

অক্ষর চুপ করে দাড়িয়ে। কি করবে বুঝে উটতে পারছেনা।

টিচার: রিংকু, ই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। আচ্ছা, তোমরা বসো।

১০#

#

অফিসে বসে মুক্ত খুব চিন্তিত। মুনার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছে। সকালে দেখেছিল চার্চ নেই। মুনার ফোনটাই চার্চ হচ্ছিল কিন্তু
সেটা খুলে নিজের মোবাইলটা চার্চ করছে। অলসতার ফলটা এখন স্পস্ট। অক্ষরের স্কুলটি মুক্তর খুব একটা পছন্দ না।
মুনার ইচ্ছা আর জেদকে সে ঘাটায়নি। স্কুল থাকবে মাঠ থাকবে না এটা মুক্তর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মুক্ত খুব
নস্টালজিয়ায় ভোগে। সে খুব মিস করে তার অতীত। সেই ফুটবল খেলা। সেই মাঠ। যদিও অনুবভ আর ঘটনার ভিন্নতা
অনেক। মুক্তর স্কুলের মাঠটি ছিল বেশ বড়। তা প্রায় পচিশ বছর আগে সে ফেলে এসেছে। সহপাঠিরা খেলতো খালি পায়ে।

মুক্তরও খেলায় ছিল বেশ আগ্রহ। কিন্তু অন্যদের চেয়ে কিছুটা সরল ও শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় খেলার অংশ হওয়া হতো না। অবশ্য এসময়েও তাই। খেলার অংশ হতে হলে হলে যোগ্যতা ভিন্ন।


মাঠের কোনার ছিল একটা বিস্তৃর্ন বট গাছ। ওই গাছের নিচে অনেক সময় কাটতো মুক্তর। দর্শক হয়ে। দেখে যাওয়া।
মাঠের কোনায় বটের ছায়ায়। একদিন সবাই ফুটবল খেলছে সেই বল গড়িয়ে আসে মুক্তর পায়ের কাছে।
মুক্ত বলটি তুলে নেয়। বলটিতে লাথি মারার আগেই সহপাঠি দৌড়ে হাজির। বলটা নিয়ে নেয়।

মুক্ত – আমারে খেলায় নিবা?
সহপাঠি – বল নিয়ে আস- তারপর খেলায় নিমু।

সহপাঠি বল নিয়ে একটু এগিয়ে জোড়ে কিক নেয়। 

মুক্ত- আমি একটু তোমাদের সাথে খেলি।
সহপাঠি – মুক্ত, তুইতো খেলতে পারিস না।

মুক্ত দৌড়ে মাঠে চরে যায়।  বল খেলার চেষ্টা করে। বল ছুটছে। বলে পিছনে মুক্ত। ছুটছে আর ছুটছে কিন্তু ছুতে পারছে না।

১১#
###
সালটা ১৯৮৬-১৯৮৭। উত্তাল দেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে। মুক্তর বাবা স্বাধীন। পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকরী জুটাতে পারেনি। ততকালিন রাষ্ট্র বা সমাজব্যাবস্থায় শুধু যোগ্যতার বিবেচনায় অর্জনটা ছিল কিছুটা কঠিন। তিনি এখন একজন মিল শ্রমিক। স্বাধীনের বর্ননা দেয়া কঠিন। ভদ্রলোক দায় নিয়েছিল সমাজের। কিন্তু সে দায় সংসারের দ্বায়িত্বে পরেছিল চরম ভাটা। চরম প্রতিবাদী, ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষ। প্রাপ্তিটা ভাগ করে নিতেই তার সুখ। তাই নিজের স্বার্থটা না বুঝে লড়ে গেছেন অবিরত। এক রাতে রেশনের চাল ভর্তি ট্রাক স্বাধীন কয়েকজনকে নিয়ে আটকে রেখেছে। সবাই মিল শ্রমিক। চালককে ধরে রেখেছে দুজন। 

চালক : পাগলামী করেন কেন? আমি তো গাড়ী চালাই আমারে ধইরা লাভ কি। 
স্বাধীন : আমার চাল ফেরত চাই- তারপর গাড়ী চলবে।
বিষয়টা মিল এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ম্যানেজার।
ম্যানেজার : হচ্ছে কি! আইন আছে এভাবে কাজে বাধা দেওয়া যাবে না। 
স্বাধীন : আমাদের এক কথা- চাল ফিরিয়ে দাও।

এরই মধ্যে আরও কয়েকজন হাজির হয়েছে। এ চালের ভাগিদার তারাও। অতএব স্বাধীনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে সবাই। সবাই খুব উত্তেজিত। স্বাধীন সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

ম্যানেজার : স্বাধীন অনেক হয়েছে। চাকরীর মায়া রাখিস।
স্বাধীন       : এ তো আমাদের রেশনের চাল। শ্রমিকের ঘামের মূল্য দেওনা। রাষ্ট্রের দেওয়া সুবিধাটুকু কেড়ে নিবা। আমরা যাবো কোথায়?  (সবার একসাথে সমর্থনের চিৎকার)।

ম্যানেজার  :    নেতাগীরি থামাও, যার যার কাজে যাও চাকুরী হারাবা। সব যাবে। 
স্বাধীন   :    আছেই বা কী। আর কত লুটে নিবা আমাদের। 

১২#
###
স্বাধীনের স্ত্রী রিতা। রিতা পড়াশুনা শেষ করলেও সংসার করাটাকে প্রদান্য দিয়েছেন। যদিও স্বপ্নের সাথে সংসারের মিলটা হয়নি। তবুও স্বামীর জন্য অপেক্ষা, ছোট মুক্তর ছুটে আসা তার জীবনের ছন্দ। 
মুক্ত ঘুমালো কিনা, পড়া শেষ করল কিনা, স্কুল, গোসল এসব নিয়ে রিতার সারাটাদিন। স্কুল ফিরে সেদিন মুক্তর খুব মন খারাপ।


রিতা –      কিরে মন খারাপ কেন? 
মুক্ত –       মা, আমাকে একটা বল কিনে দিবা।  স্কুলে  খেলতে চাই।
রিতা –      বাবা, পড়ালেখা করো। খেলাধুলা করলে পড়বা কখন। তোমারে অনেক বড় হতে হবে। 
মুক্ত –       খেললে বড় হওয়া যায় না? 

রিতা মুক্তকে কোলে টেনে নেয়। ছেলাটা তার খুব সরল।

রিতা –     পড়ালেখা করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। 
মুক্ত- তবে বাবা পড়াশোনা না কেন?
রিতা বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি উত্তর দিবে খুজে পায় না।

১৩#
###
আজ? সময় বদলাও বাস্তবতার পরিবর্তন হয়েছে একটু কমই। যতটা বদলেছে তা আনুপাতিক হাড়ে। মুক্তর ছেলে অক্ষর

আজ একই বয়সে। মধ্যবিত্তের শ্রেনী জয়ের সংগ্রাম একই স্বপ্নে বাধা, একই চর্চায়। মুনা ছেলেকে নিয়ে বসেছে হোমওয়ার্ক করাতে। যদিও ভর্তির সময় স্কুল জানিয়েছিল, পড়াশোনা স্কুলেই শেষ করে পাঠানো হবে। বাসায় বইয়ের প্রয়োজনই পরবে না। 

মুনা  :     দেখি বাবা তোমার হোম ওয়ার্কগুলো, ডাইরীটা কোথায়? 
অক্ষর ব্যাগ এগিয়ে দেয়। ব্যাগ খুলে টিফিন বক্স বের করে মুনা অবাক হয়। অক্ষর কিছুই খায়নি।
মুনা : কি ব্যাপার টিফিন খাওনি কেন?
অক্ষর চুপ করে থাকে। বিষন্ন।
মুনা : কি হয়েছে সোনা মানিক আমার?
অক্ষর চুপ করে থাকে। মায়ের দিকে তাকায়।
অক্ষর : মা যাদের গাড়ী নেই তারা কি ভদ্রলোক না?

মুনা হতভম্ব হয়ে তাকায়। এ কেমন কথা! 
মুনা: এসব তোমাকে কে বলেছে?
অক্ষর: টিচার। আর একটা চিঠি দিয়েছে।

মুনা ব্যাগ খুজে চিঠিটি বের করে। সবটাই বুঝতে পারে।

১৪#
###
বাস্তবতা আর চাহিদার সাথে চর্চাটা মানিয়ে নিয়ে অনেক মানুষ জীবনে খুশী। তাদের একজন বশীর মোল্লা।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে বিরাট ভিড়। কয়েকজন মিলে একজন মারছে। বাকিরা সে মাইর উপভোগ করছে। নিজেদের না পেরে ওঠা ক্ষোভ চোখে দেখার সুখে। পকেটমার হাতে না হাতে ধরা পরেছে। অতএব গনপিটুনি চলছে। বশির মোল্লা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। যথারীতি দাঁড়ায়।

বশির মোল্লা : ভাল কইরা মাইর দেন। মাইরা তুলা ধুনা কইরা ফালান। শালাদের জন্য রাস্তায় বাইর হওয়া যায় না।

দাঁড়িয়ে দেখা লোকজন বশীরের সাথে খুব সায় দেয়।

১৫#
###
মুক্ত অফিসে বসে খুব বিরক্ত। বিশ্বাস সাহেব খুব চটেছেন আজ। এদিকে বশীর ফোন ধরছে না। এরই মধ্যে ফোন বেজে উঠে। ফোনটা মুনার। মুক্ত মনে মনে ভাবে একটা চিন্তা মুক্ত হই।

মুক্ত : অক্ষরকে স্কুল থেকে বাসায় এনেছ?
মুক্ত : হু- ঠিক আছে।
মুক্ত : কি বললে? না না আমার দেরী হবে। অফিসে অনেক ঝামেলা চলছে-
মুক্ত : তুমি বুঝবে না-
বশির মোল্লা কাঁচের দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে ঢোকে। সালামটা একটু বড় করেই দেয়। মুক্ত মাথা নাড়ে। মুক্ত ফোনটা
ছাড়ে।
মুক্ত : ঠিক আছে- ঠিক আছে।
বশির: স্যারের শরীলঠা ভাল।
মুক্ত : কাজের খবর বলেন।
বশির : স্যার, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হইবো।
মুক্ত : অপেক্ষা করতে হবে মানে! বিশ্বাস সাহেব আপনার উপর ক্ষেপে আছেন।
বশির : ক্ষেপা ক্ষেপির কি আছে! এইসব কাজে সময় লাগে। 
মুক্ত : টাকা নেয়ার সময়তো উল্টো কথা বলেন।

বশির দাঁত বের করে হাসে। মুক্তর কাছে মনে হয় সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে বানর দেখছেন।
মুক্ত : আমি রসাক্তক কিছু বলিনি।
বশির : উপায় নাই স্যার। আরও পঞ্চাশ হাজার না দিলে কাগজ বাইর করা যাচ্ছে না। অতো সহজে কি জমির কাগজপত্র বাইর হয়! তাছাড়া এলাকার বড় ভাই কইছে পার্টির ফান্ডে টাকা দেওন লাগবো।
মুক্ত  :     আপনি দ্রুত কাজ শেষ করে আমাকে জানান। আমি কিন্তু আপনার কাজে মোটেও খুশি না। 
বশির :     আপনিতো খুশি হইতে চান না। আমি আপনারে খুশি রাখতে চাই। 
মুক্ত  :     বশির সাহেব খুব বেশি হচ্ছে। 
বশির   :    বুচ্ছি বুচ্ছি আমি যাই। 

বশির চলে গেলে মুক্ত হাফ ছেড়ে বাচে। এসব তার ভালো না লাগলেও বিকল্প জানা নেই। তার খুব ভালই মনে আছে তার বাবার গল্প।

১৬#
###
মুক্তর মনে আছে বাবার সততা, সহমর্মিতার চরম মূল্য। যা চুকাতে হয়েছে তাকে তার মাকে। একদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মুক্ত বারান্দায় বসে পড়ছে। রিতা বসে মুক্তর পাশে। স্বাধীন ঘরের ভিতরে। কয়েকজন পুলিশ সহ মিল ম্যানেজার আসে। রিতা মুক্তকে জরিয়ে ধরে ঘরের ভিতর ঢোকে। স্বাধীন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মুক্ত মায়ের সাথে জানালার পর্দার ফাক দিয়ে দেখছিল। ম্যানেজার স্বাধীনের হাতে একটি কাগজ দেয়। 

ম্যানেজার : দেখ ভাই আমি চাকুরী করি, পরিবার আছে। তোমার মত নেতাগীরি করলে আমার চলবে না।
স্বাধীন      : জানি। কিন্তু আমাদের বেতনের টাকায় সংসার চলে না। 
স্বাধীন  :     রেশনের চাল আমাদের বিশাল সার্পোট তা ও তোমাদের নিতে হবে। এখন এসেছো ওয়ারেন্ট নিয়ে। 
ম্যানেজার   :    এখানে তোমার নাম নাই। বোঝো তো বসদের ওর্ডার পাইলে নাম কিন্তু যুক্ত হইব। 
পুলিশ   :    সময় নষ্ট করবেন না। ম্যানেজার সাহেব ওনি কি ঐখানে ছিলেন। 
ম্যানেজার        :    একজনরে খুজতে আসলাম কিন্তু মিলতেছে না। চলেন আমরা যাই। 
পুলিশ    :    স্বাধীন সাহেব ভবিষ্যতের জন্য সাবধান। 

ম্যানেজার পুলিশসহ বেড়িয়ে যায়। স্বাধীন বাড়ান্দায় বসে পরে। রিতা সেদিন খুব শক্ত করে মুক্তকে ধরে ছিল।

১৭#
###
এখনও এ শহরের রাতটা ততটা রঙ্গিন নয়। যতটা উন্নত দেশগুলো তে দেখা যায়। তারপরও বিত্তবান আর সৌখিনরা কিছু না কিছু যোগান করেই নেয়। বিশ্বাস তার সমসাময়িক এবং ব্যাবসায়িক বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই একটি ক্লাবে বসে। বন্ধুত্বের কোটায় না হলেও চাকরী সূত্রে মুক্তর থাকা হয়। আজ অবশ্য লোক কম। বিশ্বাস আর মুক্ত। বিশ্বাসের নাকি আজ খুব চাপ লাগছে। তাই এই হালকা হবার চেষ্টা। রাত বাড়ছে। ক্লাবটিও সরগরম হচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। উচ্চ ভলিউমে চলছে হিন্দী গান। বিশাল ফ্লোরটির এক কোনায় অল্প বসনে কিছু মেয়ে নাচার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টার চারিদিক ঘিরে হল্লা। ধোঁয়া ছাপিয়ে সে নৃত্যে টাকা উড়াতে ব্যাস্ত অনেক। বিশ্বাস ও মুক্তর  টেবিলে হুইস্কির বোতল। 

বিশ্বাস : টাকাটা একসাথে দেয়া যাবে না। পক্ষীর মতিগতি বোঝা মুস্কিল। এক জায়গা দেখাইয়া কত জনের কাছ থেকে টাকা নিছে বুঝার উপায় নাই। তাই সাবধান। পক্ষী উড়াল দিয়া কোন ডালে বসে ঠিক আছে।
মুক্ত : উড়াল দিয়ে কোথায় যাবে। তোর রশির নাগালের বাইরে যাবে সেই ক্ষমতা নেই। তাছাড়া জমি দখলের জন্য এই লোক ছাড়া তোরও গতিও নাই।

বিশ্বাস হুইস্তিতে চুমুক দিতে দিতে একমত প্রকাশ করে। মুক্তর মাথায় চলছে বাড়ী ফেরার তাড়া। বেশী রাত হলে ড্রাইভারটা বাড়ী পর্যন্ত নামিয়ে দিবে না।

১৮#
###
সময়ের সাথে রং বদলায়। মুক্তর বাবা স্বাধীনের একটি আড্ডা জায়গা ছিল। সেখানে জয়ে চেয়ে বেচে থাকার গল্পই প্রাধান্য পেতো। রেল স্টেশানের একটু একটি চায়ের দোকান। হারিক্যানের আলোয় আলোকিত। দোকান, দোকানের সামনে ছাউনি, দুপাশে বেন্চি বসানো। নিলয় রাজের দোকান। দোকানী বেশ বয়স্ক। আসলে অনেক ছোট থেকেই স্বাধীন এই দোকানটির সাথে পরিচিত। অলক রঞ্জন, সুরুজ, কামাল, বাচ্চু আর স্বাধীন। সবাই একই পাড়ার। প্রায় একই বয়সি। একই মিলে নানা পজিশনে কাজ করেন। সবার মধ্যে পুথিগত শিক্ষার পার্থক্য বেশ। এখানে সবচেয়ে শিক্ষিত স্বাধীন। চায়ের কাপে চুমুকে বা জীবন যুদ্ধে সে প্রর্থক্য ধরা পরে না। 

অলক : এখন যে অবস্থা তাতে মনে হয় কযেকদিন গা ডাকা দিয়ে থাকো।
সুরুজ : আমরা কি ভুল করেছি! রেশনে চালের নামে যে পঁচা ক্ষুদ দেয় তা মুখে তোলা যায় না। বাজার থেকে বেশী দামে কিনার ক্ষমতাও নাই। তাই গ্রাম থেকে খাওয়ার জন্য চাল আনছি।
বাচ্চু : আমরা তো ব্যবসার জন্য চাল চাই না। 
সুরুজ : রেশনে ভাল চাল দিলেই তো সব মিটে যায়।
অলক : সাদা কলারের সাহেবদের জন্য সবই ঠিক আছে। শুধু আমাদের বেলায় সমস্যা।
সুরুজ : আমাদের চরম আন্দোলনে যাওয়া উচিত ।
বাচ্চু : কর- আন্দোলন কর। চালের জন্য আন্দোলন কর। বৃটিশরা যেমন গুতিয়ে গেছে তেমনি পাকিস্তানী গুতিয়েছে, আর এখন নিজের লোকেরা।
স্বাধীন : তা তো করছেই।
সুরুজ : বাড়ীতে পুলিশ গিয়েছিল?
বাচ্চু : বন্ডে সই না করলে পুলিশ যাবে, এ্যরষ্টে করবে। । চাকরিও ফিরে পাবে না।
স্বাধীন : বন্ডে সই করে সবার সাথে বেঈমানি করতে পারবো না।
অলক : আমারও এই একই কথা।
বাচ্চু : একই কথা! খালি সবুর কর দেখ কি হয়।
স্বাধীন : সবুর করার কিছু নাই। সবই স্পষ্ট। আন্দোলন ছাড়া গতি নাই।

নিলয় রাজ শুধু চেয়ে দেখে। ব্রিটিশ পাকিস্থান হয়ে এই পর্যন্ত দেখছে সে। তার কিছু বলার নেই। সে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে।

১৯#
###
স্বাধীন বাড়ী ফিরে দেখে রিতা ভিশন রাগ। মেয়েদের রাগটা টের পাওয়া যায় মুখের দিকে না তাকিয়েই। রান্নাঘর থেকে শব্দের মাত্রা সব জানান দিচ্ছে। রিতা চুলায় কিছু গরম করছে। স্বাধীন রান্না ঘরের দরজায় বসার চেষ্টা করল। এক প্লেটে ভাজা মাছ দেখে হাতে তুলে নিল।

রিতা : কিসে আমাদের গতি বলতে পারে । 
স্বাধীন:   গতি নাই। জানিও না।
রিতা: ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। মুখে ভাত দেয় নাই।
স্বাধীন মুখ থেমে গেল। মুখের ভেতরে মাছ কেন যেন কংক্রিট হয়ে আসছে।
স্বাধীন : কেন? কি হয়েছে?
রিতা : বল- বল কিনে দিতে হবে।

স্বাধীন ভাবছে, তিন মাসের মাইনে বাকি। দোকান থেকে বাকিতে চাল, অলকে জালে ধরা পরা মাছ ভাজায় এই বেলা পার। কাল ভাত হলেও ডাল নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, সেখানে বারতি প্রেমটা কি করে? ছেলেটি বল চায়। কিন্তু সে বৃত্তে তো স্বাধীনকেই পাক খেতে হচ্ছে।

২০#
###
সময়ে সাথে প্রয়োজন বদলায়। বদলায় চাহিদাও। সেকাল একাল সবকালেই যুদ্ধ করতে হয় শ্রেনী-উত্তির্ন সংগ্রামিদের। মুক্ত অফিস সেরে বাসায় ফিরছে। উচ্চ ভলিয়মে হিন্দি সিরিয়াল চলছে। বোঝা যাচ্ছে পরিবেশ তার অনুকুলে না। ফ্রেস হয়ে দেখলো টেবিলে খাবার চলে এসেছে। অক্ষরের রুমের দরজা চাপানো। মানে সে ঘুমে। ভাবলো দরজা খুলে এক নজর দেখবে কিনা। কিন্তু সেটা করা যাবে না। কারন দরজা খুললে শব্দে অক্ষরের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। টিভি শব্দ কমালে মুনা খেপে যাবে।

অতএব সে চুপচাপ খাবার টেবিলে বসলো। টেবিলে বসতেই মুনা টিভির শব্দ কমিয়ে দিল। দুজনের প্লেট এগিয়ে খাবার বারতে লাগল। মুক্ত খাবার মুখে দিয়ে

মুক্ত : রান্নাটা বেস হয়েছে। তুমি না থাকলে।
মুনা : গাড়ী চাই- গাড়ী। বুঝতে পেরেছো? গাড়ী। বাচ্চাটা খুব কান্নাকাটি করছে । টিচার নাকি বলেছে যাদের গাড়ী নাই তারা নাকি অভদ্র লোক।
মুক্ত : টিচার বলেছে! আশ্চর্য!
মুনা : এতে আশ্চর্য হবার কি আছে। স্কুলের প্রায় সবার গাড়ী আছে। আর আমাদের নেই!
মুক্ত : হবে- হবে একদিন সবই হবে। সবুর কর।
মুনা : হ্যাঁ সবুর কর। কিছু বললেই সবুর কর। নিজের বেলায় ষোল আনা।
মুক্ত : কিসের ষোল আনা! উল্ট পাল্টা কথা বলবে না।
মুনা : এই যে সারা রাত বন্ধুর সাথে কাটাও- কি দেয় সে- কথা বললেই উল্টাপাল্টা-
মুক্ত : এই বাজারে একটা চাকরী দিয়েছে।

মুনা : দয়া করেছে!
মুক্ত : দয়া কেন! আমার যোগ্যতা আছে।
মুনা : যোগ্যতা আছে! যাও যোগ্যতা দিয়ে আরও বেশী বেতনের একটা চাকরী জোটাও না- দেখি কেমন পার-
মুক্ত : নিজে কি করো! সারাদিনতো রান্নাবান্না আর টেলিভিশন দেখা-
মুনা: আমি কিছু করি না। তোমার কাজটা করো।

মুনা খাবার ফেলে উঠে যায়।মুনার প্লেটের খাবার কমেনি মোটেই। মুক্ত প্লেটে ভাত নাড়তে নাড়তে ভাবে, কি ভাবে কি করবে।

২১#
###
বাবা আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য অনেক। মুক্ত তার চরিত্রের প্রতি অধ্যায়েই বাবা চরিত্রের গুরুত্ব দিতে চায়। সবসময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু চেষ্টা থাকে সবসময়। অক্ষর বিছানায় ঘুমাচ্ছে। সকালের আলোটা এসে ওর মুখে পরেছে। মুক্ত ভাবছে কি মায়াবি ছেলাটা তার। নিষ্পাপ ঘুম। একবার ডাকবে ভেবে আবার ডাকলো না। আর একটু ঘুমাক। কাল রাতে মুক্ত ঘুমায়নি। তার মস্তিস্কে ছুটেছে নানা ভাবনা।সন্তানের পাশে বসে মুক্ত কিছুটা অপরাধ বোধে ভুগছে। সে ভাবছে, সব কিছুই তো দিতে চায় সে, যা সে পাইনি। বাবা হিসাবে স্বামী হিসাবে। কিন্তু হয়ে উঠে না, অপেক্ষা করতে চাই। তোমরা ও অপেক্ষা কর। এইটুকু সহযোগীতা একজন বাবা বা স্বামীকি পাবে না। মুক্ত স্থির হতে পারে না। তার খুব বাবার কথা মনে পরে।

২২#
###
মুক্তর ছোট বেলায় তার বাবাকে দেখেছে খুব নির্লুপ্ত। কিন্তু মুক্ত বাবার ভালবাসাটা অনুভব করতো। একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। স্বাধীন প্রায় কাক ভেজা হয়ে বাড়ী ফিরেছে। রিতা হাত থেকে ঘামছাটা নিয়ে সে মায়ের ঘরের যায়। মুক্ত ঘুমাতো তার দাদীর সাথে। মুক্ত ঘুম, মুক্তর দাদী বসে আছে। মুক্তকে বিছানার এক কোনায় ঠেলে দিয়ে। বাকি অংশে বিছানা গুটানো। কারন জানালার উপরের অংশ দিয়ে পানি আসছে। স্বাধীন সে রাতে বৃষ্টিতে ভাজে পুরানো টিন দিয়ে জানালার উপরের অংশ জোড়া দিয়ে ছিল। রিতা পুরো বিষয়টি বিস্ময়ের সাথে দেখছে। আসলে প্রেমটা সবসময় দৃশ্যমান নয়। স্বাধীন শোবার ঘরে ফিরলে রিতা তেলে বাটিটা হাতে দেয়।


রিতা- তেল দিয়ে দেই? ঠান্ডা লেগে যাবে।
স্বাধীন : দেখ সামনের মেলায় তাকে বল কিনে দেব।

স্বাধীন নিজেই গায়ে তেল মাখছে। রিতা তাকিয়ে দেখে। এই খালি শরীরটি তার খুব পরিচিত। তার চেয়ে বেশী জানা এই শরীরে ঢাকা মনটা।

২৩#
###

সময় আসলে বদলেছে অনেক। শরীর, মন থেকে চাহিদা অন্যকিছু। অন্দোলনের ইসু যেমন আলাদা, ধরনও তেমন। আজ মুক্ত সোফায় ঘুমাচ্ছে। এখন প্রায় সকাল। সামনে টেলিভিশন চলছে। মুনা এসে টেলিভিশন বন্ধ করে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে, তারপর পাশের রুমে চলে যায়। মুক্ত উঠে বসে। মুক্ত সব সময়ই নষ্টালজিক। তার খুব মনে হয় একটু বাড়ী যাবে।

২৪#
###
দুপুরের রোদটা পরেছে বেশ। যে গরম। মুক্ত ভাবছে বিকালে বাসে উটলে ভাল হতো। যদিও সেক্ষেত্রে রাতের মধ্যে বাসায় পৌছানো কঠিন হতো। বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা পথ হাটতে হয়। রোদটাও একটু দয়া দেখাচ্ছে। এই রোদে হাটাটা বিরক্ত লাগছে না। আর বাড়ী ফেরার এক আলাদা সুখ তো কাজ করেই।বাড়ীটা যদিও এখন খালি পরে আছে। তালা ঝুলছে দরজায়। ঘরটিও চরম ভংগুর দশা। এক পাশ ভিটাতে ডেবে গেছে। মুক্তর মা রিতা মারা গেছে বেশ কয়েক বছর। বাবা সে তো দীর্ঘ্য কাল। তারপরও রাড়ী ফেরার এক নিজেস্ব সুখ। সে নিজেকে খুজে পায়। খুজে পায় তার বাবাকেও। বাড়ীর উঠোনে পাড়া দিতেই মুক্তর মনে হয় তার বাবা কথা বলে উঠলো।

স্বাধীন-     কিরে পাখি আমার
মুক্ত-        বাবা 
স্বাধীন-     মনটা খারাপ ?
মুক্ত-       বাবা আমি কবে পাখি হব? 
স্বাধীন-    তুইতো আমার পাখিই
মুক্ত-       কিন্তু খাচার ভিতর অচিন পাখি
স্বাধীন-    তুইতো ধরা পড়েছিস, মনবেড়ী তোর পায়ে।

মুক্ত তার বাবা কে খোজে। অথবা সে খুজে বেড়ায় কোন আশ্রয়। সে তার বাবাকে দেখতে চায়, অনতত একটি বার। মুক্তর খুব ইচ্ছে করে বাবা বলে একবার চিৎকার করতে। কিন্তু জীবনে অনেক না পারার মত এটাও হয়ে ওঠে না।
মুক্ত খুব নিচু গলায় গাওয়ার চেষ্টা করে-
মন তুই রইলি খাচাঁর আসে, 
খাচাঁ যে তোর কাঁচা বাঁশে, 
কোনদিন খাচাঁ পড়বে খশে।

২৫#
###
চেনা রাস্তার অচেনা পথ ধরে হাটছে মুক্ত। এযুগেও মাটির রাস্তা মনে অজানা দোলা দেয়। দুধারের বয়সি গাছগুলো আরও দ্বায়ীত্ববান হয়ে ছায়া বিলাচ্ছে। পাখির ডাকও মিলছে মাঝে মধ্যে। এপথে অনেকবার পাখি হয়েছে মুক্ত। আজ সে আবার ফিরে যেতে চায় সেই সুখের দিনগুলোতে। নদীর তীর, মেলা, চরকি ঘোরা, পালাগান, পুতুল নাচ, নাড়ু-মোয়া-মুরকি আর হরেক রকমের পণ্যের পসরা। হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেয়েও বাবা তার হাতটি ছাড়তো না। আজও একটি হাত চায় মুক্ত। যা তাকে শক্ত করে ধরে থাকবে। মেলায় সাজিয়ে রাখা সব পন্যই মুক্তর মনে হতো কিনে নেই। তারপরও আগ্রহ জায়গা ছিল খেলনায় বেশী। তার হয়ত পাওয়া হতো না। এটা মনে নেয়ার চেষ্টাই তাই বেশী ছিল। 

শত অভাবেও মুক্তর বাবা ছেলেকে খুশী করতে চাইত। নিজ হাতে কাগজের পাখী বানিয়ে দিতো। মেলা থেকে অনতত একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিতো। একদিন মেলায় স্বাধীনের সাথে একজন সহকর্মীর দেখা হয়। দাঁড়িয়ে কথা বলছিল দুজন। মুক্ত দূর থেকে খেলনার দোকানে বল দেখতে পায়। বাবার হাত ছাড়িয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। মুক্ত হাওয়াই মিঠাই হাতে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলগুলো খুব করে দেখতে থাকে। মুক্ত হাত দিয়ে বল স্পর্শ করবে কিনা ভাবে। পাশেই আর এক ভদ্রলোক তার সন্তানকে নিয়ে এসেছে। মুক্ত ভাবে বলটা একটু ছুয়ে দেখি। হাতটি বাড়াতেই ভদ্রলোক বলটি নিয়ে তার সন্তানের হাতে দেয়।

ভদ্রলোক : পছন্দ অইছে?
বাচ্চাটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
ভদ্রলোক : ভাই সাব বলের দাম কত?
দোকানী : সাতান্ন টাকা।
ভদ্রলোক : সাত টাকা কম নেন।
দোকানী : কম অইবো না।
ভদ্রলোক : দুই টাকা কম নেন।
দোকানী : এক পয়সাও কম অইবো না।
বাচ্চাটি বল দুহাতে আকড়ে ধরে আছে। 
ভদ্রলোক : কি আর করা দেন।

ভদ্রলোক মূল্য মিটাতেই বাচ্চাটি আনন্দে বলে হাত দুলাতে দুলাতে মেলার ভিড়ে হারিয়ে যায়। মুক্ত বিষন্ন হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখে। কি ভেবে আবার একটি বলে হাত দেয়।

দোকানী : এই ছেমরা অনেকক্ষণ ধইরা দেখতেছি খাড়াইয়া রইছ। বল কিনবা?
মুক্ত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
দোকানী : ৫৭ টাকা দাও ।
মুক্ত : অতো টেকাতো নাই।
দোকানী : তাইলে বলে হাত দিবা না- ভাগ এইখান থাইকা-
দোকনী ধাক্কা দিয়ে মুক্তকে ফেলে দেয়। স্বাধীন দূর থেকে ধাক্কা দিতে দেখে। কাছে াসতে আসতে বুঝতে পারে কি ঘটছে।
দ্রুত এগিয়ে আসে মুক্তকে তোলে। বলটি হাতে নেয়।
স্বাধীন : দাম কত?
দোকানী : ৫৭ টাকা।
স্বাধীন : ও-
স্বাধীন তার অক্ষমতা আড়াল করতে চেষ্ঠা করে। মুক্তর মাথায় হাত রাখে।
স্বাধীন : চল- এইখানে দাম বেশী। তোমারে অন্য দোকান থেকে কিনে দিবো।

মুক্ত সরল ভাবে মাথা নাড়ে। হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে তাকায়। দেখে গোলাপী হাওয়াই মিঠাই অনেকটাই চুপসে গেছে। দূর থেকে বয়াতীর গান ভেসে আসছে।
মন তুই রইরি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খশে।

২৬#
###
সেদিন মেলা থেকে ফেরার সময়টা ছিল এক পরন্ত বিকেল। বাড়ী ফেরার পথে একটি নদী পরত। নদী পার হতে হত না তবে নদীর পারের রাস্তা দিয়ে ফিরতে হতো বাড়ী। মুক্তর ডান হাতটি স্বাধীনের বা হাতে ধরা। মুক্তর সে হাতের লাঠিতে চুপসে যাওয়া হাওয়াই মিঠাই। বা হাতে কাগজের পাখি। প্রচন্ড বাতাস। মুক্তর হাতের পাখিটি যেন উড়ে চলে যাবে।

মুক্ত : বাবা এটা কি পাখী?
স্বাধীন : একটা নাম দিয়ে দাও। বুলবুলি, টিয়া, তোতা, শঙ্খচিল যে কোন নাম-
মুক্ত : এই পাখীটা কোথায় থাকে?
স্বাধীন : যখন যেখানে ইচ্ছে-
মুক্ত : তোমার মতো?
স্বাধীন : আমি আবার পাখী হলাম কবে থেকে!
মুক্ত : এই যে তুমি কোথায় চলে যাও- শুধু মাঝে মাঝে রাতের বেলা আসো।
স্বাধীন : সন্ধ্যার পরই পাখীরা ঘরে ফিরে। 
স্বাধীন কথাটা বলে নিজেই হাসছে। মুক্ত কিছু বুঝতে পারে না।
মুক্ত : আমিও পাখী হবো। উড়ে বেড়াবো- ঘুরে বেড়াবো-

স্বাধীন আবারও হাসে। মুক্ত বাবার হাত ছেড়ে পাখী হাতে উড়ার ভঙ্গিতে দৌঁড়াতে থাকে।

২৭#
###
হাওয়াই মিঠাই একালে খুব একটা আবেদন জাগায় না, যতটা ফাস্টফুড। সবকিছুই ফাস্ট তাই ফুড আর পিছিয়ে পরবে কেন। সেও গতি বদলে রং বদলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিয়েছে। একটা সময় বাঙ্গালীর বাহিরে খাবার বলতে পুরি, চটপটি। একটু ভাল কিছু চাইলে চিকেন পোলাও। সেই চিকেন সাহেবের আজ কত রেসিপি। সেই রেসিপির মূল্য চুকিয়ে সুখ খোজেন একালের বাঙ্গলী। মুক্তকেও সময়কে মূল্য চুকাতে হয়। সেটা পারাতেই সফলতা। আর সফরতায় সুখ। আজ মুক্ত মুনা আর অক্ষর বেড়াতে বেড়িয়েছে। নিজেদের স্টান্ডার বোঝাতে মুনার পছন্দের জায়গায়। অক্ষরের আকর্ষন ফ্রাইড চিকেনে। সে লেগ পিছে
মনোযোগী। মুনা ব্যাস্তো ছবি তোলায়। কখনও ফ্রন্ট ক্যামেরায় কখনও ব্যাক ক্যামেরায়। খাবার, চেহারা, পোশাক থেকে গ্রুপ পর্যন্ত। মুক্ত খুব বিরক্ত।

মুক্ত- প্লিজ একটু থামো। খাবারটা খাও। আর কত ছবি তুলবে। 
মুনা- সো। এই মোবাইলটা জন্মদিনে বাবা দিয়েছিল বলে। কোনদিন একটা মোবাইল কিনে দিয়েছো।

মুক্ত চুপ করে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। কারন কিছু বললে ওপাশ থেকে উত্তর আসবে আরও বড় করে। মনে মনে ভাবছে একবার কিনে দিয়েছিল। সেটাও মনে করা যাবে না। আবার সেটাতো স্মার্ট ছিল না। হঠাৎ খেতে খেতে অক্ষর প্রশ্ন করে বসে।

অক্ষর : ড্যাডি তুমি কি কাজ করো?

মুক্ত : অফিসে যে সব কাজ করতে হয় তাই করি।
অক্ষর : অফিসে তো রিংকুর বাবাও কাজ করে। ওরা আরেকটা নতুন গাড়ী কিনেছে। লাল রঙ এর।
মুক্ত একটু বিব্রত হলেও মুনা বিষয়টা লুপে নেয়ার চেষ্টা করে। 
মুনা : রিংকুর বাবা তো-
মুক্ত : তাতে কি- ওদের এক্সর্টা ইনকাম আছে মুনা।
অক্ষর : এক্সর্টা ইনকাম কি বাবা?
মুক্ত : সে তুমি বঝবে না।
অক্ষর : আমি জানি। রিংকু আমাকে বলেছে। ওর বাবাকে লোকজন বাড়ীতে এসে টাকা দিয়ে যায়। ড্যাডি তোমাকে দেয় না
কেন? তাহলে তো তুমিও একটা গাড়ী কিনতে পারতে।
মুনা : বেশী কথা বলবে না। চুপচাপ খেয়ে নাও। কতদিন বলেছি ছেলের সাথে বাংলায় কথা বলবে না। 
অক্ষর : তুমি কি বোকা মা। আমি বাংলা বুঝি।
মুক্ত খাবারে মনযোগী হবার চেষ্টা করে কিন্তু নিজেকে সংযত করতে পারছে না।
মুক্ত : আমি বলি না বলি তাতে কিছু যায় আসে না। এরা সবাই জানে কিভাবে তার বাবারা বেতন ছাড়াও আয় করে।

২৮#
###
মুক্ত খুব চিন্তিত সব মিলিয়ে। বেশ চাপ অনুভব করছে মস্তিস্ক জুড়ে। সে চাপ কদিন তার শরীরে ছুয়ে যাচ্ছে।

এক সকালে অফিসের সামনে মুক্ত সিগারেট খাচ্ছে। শহরটি প্রচুর গাড়ী। চলন্ত গাড়ী দেখতে দেখতে ভাবে এতো গাড়ী কিন্তু এর একটি তার নিজের নয় কেন। দুর থেকে ড্রাইভার ফিরোজ বিষয়টি লক্ষ করে। এই লোকটিকে মুক্ত আসলে বুঝতে পারে না। বশীরকে সে বোঝে। কিন্তু ফিরোজের বিষয়টা পরিস্কার না। হয়ত ফিরোজও শ্রেনীউত্তির্ন হতে চায়। সে চায় বশীর জায়গায় যেতে। ফিরোজ কাছে আসে। 

ফিরোজ : স্যার। কি সিদ্ধান্ত নিলেন?
মুক্ত : সিদ্ধান্ত? কোন বিষয়ে?
ফিরোজ- গাড়ী একটা কিন্না ফালান। দেখমু?
মুক্ত- হ্যাঁ শীঘ্রই নেব।
ফিরোজ : স্যারের বন্ধু হইয়াও এতদিনে গাড়ী কিনতে পারেন নাই! 
মুক্ত- দেখি। 
ফিরোজ- হাতে একটা ভাল গাড়ী আছে আছে। দেখবেন?
মুক্ত : আরে গাড়ীতো একদিন হঠাৎ করে কেনা ঠিক না। খোঁজ খবর নিয়ে একটা ভাল গাড়ী কিনবো।
ফিরোজ : খোঁজ খবরতো কম নেন নাই! অনেক দিন ধইরা আমার কানের কাছে গুনগুন তো কইরাই যাইতাছেন- গাড়ী কেনার কোন লক্ষণ দেখতাছি না। 
মুক্ত- বেশী কথা বলো না। ওটা বেয়াদবি হয়ে ওঠে।

ফিরোজ- হ! এসব আামাগো জানা আছে।
মুক্ত : জানা আছে মানে!? কি বলতে চাও?
ড্রাইভার : না- না- কিছু বলতে চাই না। কত লোক দেখলাম- মুরোদ থাকলে মাইনষের গাড়ী কিনতে সময় লাগে না।

মুক্ত স্তম্ভিত হয়ে যায় ফিরোজে কথায়। কিছু বলতে পারে না। কি বলবে বুঝেও উটতে পারে না। খোভ রাগ জেদ সবটাই সিগারেটের উপর ঝেরে দেয়। জোড়ে একটা টান দিয়ে সিগারেটা দুআঙ্গুলে পিসে ফেলে। কোন কিছু না বুঝে হাটতে শুরু করে। মনে মনে শুধু একটি ভাবনা তারা করে বেড়াচ্ছে। -হার মানতে চাই না। হার মানা যাবে না। কোন ভাবে না।

২৯#
###
সকল সংগ্রামই কোন না কোন স্বাধীনতার। তবে সবল স্বাধীনতা সমাজ আর মানবতার জন্য হয় না। তাই বেছে নিতে হয়। চিনে নিতে হয়। মুক্তর জীবনের এক বীপরীত বাস্তবতার সংগ্রাম ছিল স্বাধীনের জীবনে। শ্রেনীউত্তির্নের সংগ্রামের চেয়ে শ্রেনীবৈষম্যের সমাজব্যাবস্থায় বেচে থাকার সংগ্রামই ছিল বাস্তবতা। 
এক রাতে। স্বাধীন তখন পলাতক। পুলিশ তাকে খুজছে। স্বাধীন খুব সাবধানে চলাফেরা করছে। রাতে নিলয় রাজের চায়ের দোকানে সবাই মিলিত হয়। হারিক্যানের আলোয় আলোকিত চির চেনা জায়গা। আজ দোকানে বসে নিলয় রাজের ছেলে।

চা বিক্রেতা: দাদা তাড়াতাড়ি ভিতরে যান। মাঝে মাঝেই টিকটিকি আসে। কখন কি হয় কওন যায় না।
স্বাধীন : আর কি হবে জেলের ঘানি টানতে হবে।

স্বাধীন হাসতে হাসতে ভিতরে ঢুকে যায়। চায়ের দোকানের পিছনে একটি ছোট্টো ঘর। আগে নিলয় পরিবার সহ থাকতো। এখন আর এখানে থাকে না তাই রুমটা খালিই পরে থাকে। স্বাধীনরা এখন নিজেদের জন্য রুমটি ব্যাবহার করেন। আগে থেকেই অলক, রঞ্জন, সুরুজ ও বাচ্চু বসে আছে। স্বাধীন আসতেই ওরা একটি আলাদা শক্তি পায়।

রঞ্জন: দাদা আসছো। পথে কোন সমস্যা হয়নি তো?
স্বাধীন: আর সমস্যা। অপরাধ করবে ওরা আপরাধী হয়ে ঘুরতে হবে আমাদের।
বাচ্চু: বাড়ীর কি খবর.?
স্বাধীন: কোন রকম বাচিয়ে রাখছি। 
অলক : দাদা কি করবো বুঝতে পারছি না। আর কতদিন? আপনার বৌদি বাচ্চা সবাই দেশের বাড়ীতে পাঠাইতে হইছে।
বাচ্চু : সহ্যের সীমা আছে। আমার মনে হয় আপস-রফা কইরা ফালান ভাল।

চা বিক্রেতা চা নিয়ে আসে। একে একে সবাকে চা দিতে থাকে। সবাই চা হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। স্বাধীন চায়ের ভিতর তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে থাকে। চা বিক্রেতা সবাইকে এক সাথে বাইরে যেতে নিষেধ করে বেড়িয়ে যায়।

স্বাধীন : হু, সবই ঠিক আছে।  কিন্তু আমাদের হার মানা ঠিক হবে না। হার মেনে নিলে আমাদের আর ফেরার পথ থাকবে না। 
অলক : ঠিক বলেছো দাদা। আপস করতে গেলে পরে বড় মূল্য চুকাতে হবে।

৩০#
###
মুক্তর আজ মেজাজ খুবই খারাপ। বশির মোল্লার সবসয়ই ইনফরমেসনে ভেজাল থাকবেই। ড্রাইভার ফিরোজকে নিয়ে আজ এসে ছিল নতুন প্রজেক্ট দেখতে। পথে গাড়ীর চাকা পাংচার। ড্রাইভার অতিরিক্ত চাকা তোলেনি গাড়ীতে। অগত্তা রিকশার চাকায় পথ চলছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে একটু পরে। রাস্তা খুব খারাপ। আসলে রাস্তাই নেই। বিভিন্ন বাড়ীর জায়গা নিয়ে কোন রকম চাপা একটু জায়গা দিয়ে চলছে রিক্সা।  হঠাৎ রিকাসার চাকাও পাংচার। 


রিক্সাওয়ালা: স্যার, এই রাস্তা দিয়ে টাইন্না নিতে পারমু না। নামেন।
মুক্ত : উহ্- সময় বুঝে পাংচার- ফেরার ব্যবস্থা কি হবে?
বশির : স্যার নামেন- চলেন হাটি।
মুক্ত : হেঁটে! আর কত দুর?
বশির : এখানে রিকশা পাওয়া যাইবো না। চলেন।

সে আবারো এক হাজার টাকার নোট রিকশাওয়ালাকে দেয়।রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মুক্ত বিষয়টা বুঝে ভাড়াটা পরিশোধ করে।

মুক্ত ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা পাচ্ছেনা। খুব বিরক্ত নিয়ে হাটছে। আসলে হাটাও যাচ্ছে না। রাস্তাটা হাটারও উপযুক্ত না। মনে মনে ভাবছে- এই প্রোজেক্ট কনফার্ম হলে এখানেও মানুষ জমি-ফ্লাট কিনবে। কতটা আজব। 

বশির : অফিসের গাড়ী না নিয়ে ভাড়া গাড়ী নিয়ে আসলেইতো ভাল ছিল স্যার।

কিছু দুর এগোতেই পথটা চেহারা বদলালো। সবুজ গাছগাছালি দুপাশে। সরু হলেও কখনো সুরকি, কখনো খড় বিছানো পথে ওরা হাঁটে। 

মুক্ত : অফিসের গাড়ী প্রজেক্ট ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত এই এলাকায় আর নিয়ে আসা যাবে না। 
বশির: একদম ঠিক বলছেন স্যার।
মুক্ত : আগে থেকে ভাল রিকশা ঠিক করে রাখবেন না!
বশির : তাইলেতো গ্যারেজে নিয়া পরীক্ষা করতে হয়। এক হাতে কতদিক সামলামু। এক কাজ করেন স্যার একজন রিকসা
মিস্ত্রিকে সাথে রাখলে খুব ভাল হয়।
মুক্ত : জমির দালালি করতে করতে দেখি বুদ্ধির মাথা খেয়েছেন!
বশির : কি যে বলেন স্যার। বুদ্ধির প্যাঁচ না করতে পারলে আপনাগো লগে থাকতে পারমু।
মুক্ত ও বশির দেখতে পায় দূরে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে। হাতে লাঠি-সোটাও আছে। দুর থেকে ভংগিমা দেখে বোঝা যাচ্ছে
উদ্দেশ্য। হঠাৎ বশির থমকে দাঁড়ায়।
বশির : স্যার আর আগানো ঠিক অইবো না।
মুক্ত : কেন?
বশির : সামনে তাকান।
মুক্ত: দেখেছি। কিন্তু আপনার লোকজন কোথায়?
বশির : আছে তো।
মুক্ত : তাহলে ওরা আসে কি করে!

বশির : পেটের তাগিদে- মাথা গোঁজার ঠাই রক্ষা করতে।
মুক্ত : আপনি আছেন কি করতে- চলেন দেখা যাক কি হয়।
বশির : দেখতেই যখন চান- তাইলে চলেন সামনে আগাই-

মুক্ত হেটে আগানোর চেষ্টা করতেই বশির পেছনে দৌড়ে পালায়। দূরে দাঁড়ানো মানুষজন ওদের এগিয়ে আসতে দেখে রাস্তার পাশ থেকে সরে এসে রাস্তা আগলে দাঁড়ায়। ওরা মুলত কাজ ফেলে মাঠ থেকে এসেছে। বেশীর ভাগই কৃষক। কারো কারো হাতে কৃষিযন্ত্রও আছে। যেন এদিয়ে রক্ষা করবে তাদের ভূমি।

৩১#
###
সময়ের সাথে ছবি বদলায়। তুলির যত্নে আকা বং দীর্ঘ্য কালে ফিকে হয়ে যায়। স্বাধীনের যখন বাচা মরার লড়াই তখন সুযোগ সন্ধানীরা ছিল সোচ্চার। কালে কালে চিত্রপট বদলায় কিন্তু একই ক্যানভাসে। আজকের ঘটনা মুক্তর বাবার দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। মুক্ত স্কুল থেকে ফেরার পথে পরত বাবা কর্মক্ষেত্র। একদিন স্কুল সেরে বাড়ী ফেরার সময় মুক্ত দেখতে পায় বাবার বন্ধুরা মিছিল করছে। চরম উত্তেজনা। চাকরি ফিরে পাবার দাবীতে এই মিছিল। স্বাধীন, অলক রয়েছে মিছিলে। মিছিলটি কারখানা এলাকা ছেড়ে রেল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। মুক্ত কলোনির দেয়ালে বসে দেখে সে মিছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়। ওদের তাড়া করে। ছত্রভঙ্গ করে দেয় সবাইকে। মুক্ত ভয় পেয়ে দেয়াল থেকে লাফিয়ে নেমে এক দৌড়ে বাড়ী চলে যায়। সে দিন মুক্ত খুব ভয় পেয়েছিল। মায়ের কোল জড়িয়ে কান্না করেছিল লম্বা সময়। আজও সেই একই রকম ভয় কিন্তু একটি জায়গা নেই। যেখানে তার দুফোটা জল ধারন করবে।

৩২#
###
আজ মুক্ত খুব তাড়াতড়ি বাড়ী ফিরেছে। বসার ঘড়ে ব্যাগটি রাখতেই মুনা একটু ঘেটে দেখার চেষ্টা করল। আশা করে ছিল হয়ত কিছু। কোন কিছু না পেয়ে ব্যাগটি নিয়ে ভেতরে চলে গেল। টিভিতে চলছে বউ-শ্বাশুড়ীর কুটনৈতিক বিষয়ক নাটক।

অক্ষর একটি খেলনা গাড়ী নিয়ে খেলছে। গাড়ীর চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে গাড়ীর সাথে কথা বলে।
অক্ষর : পিপ্ পিপ্ পিপ্- আমার বাবাও গাড়ী কিনবে- আমিও গাড়ী চড়ে স্কুলে যাব- পিপ্ পিপ্ পিপ্-
মুনা ঘরে কাজ করতে করতে দেখছে। গাড়ী মেঝেতে রেখে আগ পিছু করে ঠেলে দেয়। অক্ষর গাড়ীর পিছনে ছুটতে থাকে।

গাড়ীটি এসে মুক্তর পায়ে এসে আটকে যায়। মুক্ত অক্ষরকে কোলে তুলে নেয়।
 
মুক্ত-        বেটা, তোমাকে একথা কে বলেছে। 
অক্ষর-     কেন বাবা, রাস্তায় কত গাড়ী, তুমি বেতন পেয়ে একটা নিয়ে আসবে। 
মুনা-       অক্ষর, যাও হোম ওয়ার্ক শেষ কর। 

অক্ষর চলে যেতেই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে মুনা পাশে বসে। একটু কাছে আসার চেষ্ঠাই করে। মুক্ত মনে মনে ভাবে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরার সুবিধা তো বেশ।

মুনা-       এই শোন না, দেখ না ব্যাংকের লোন নিয়ে বা অন্য কোন ভাবে……
মুক্ত-      আমাকে একটু সময় দাও, সব হবে।  
মুনা-      সময় নিতে নিতে তোমার সব হবে। কিন্তু তার কোন ব্যবহার থাকবে না। 

মুনা উঠে চলে গেলে মুক্ত কিছুটা বিব্রতই হয়। প্রেম আর প্রপ্তির সম্পর্ক খোজে বিষন্ন হয়ে।

৩৩#
###
ছোট বেলায় স্কুলে যাবার সময় মা মুক্তকে এক টাকা দিত। তিন হরিনের সেই এক টাকায় জুটত অনেক কিছু। যেদিন চকচকে নোট পেত সেদিন দেখতে দেখতে স্কুলের দিকে হাঁটত। সে এক অন্য রকম সুখ। সে সেই এক টাকায় অদ্ভুদ শক্তি পেত। অনেক স্বপ্ন-স্বাদ পুরনের একটি টুকরো।

রেলওয়ে কলোনীর স্কুলের ক্লাসরুম। টিফিনের ঘন্টা বাজতেই সবাই দৌড়ে মাঠে। কেউ খেলছে মাঠে, কেউ ফুচকা- চটপটিতে মনোযোগী, কেউবা বেলুন ফুটাতে ব্যাস্ত। মুক্তও খেলবে ভাবে কিন্তু খেলতে নিবে কিনা সে সংশয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে যায়। স্কুলের সামনে বসা অস্থায়ি খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে অনেকে। মুক্ত পকেটে হাত দিয়ে পয়সার অস্তিত্ব অনুভব করে। চোখে আনন্দ। সামনে ফুচকা গুলোর দিকে তাকাতেই স্বপ্ন-স্বাধের পরিবর্তন দেখা দেয়। মুক্ত হাত দিয়ে বুক পকেট স্পর্শ করে। টিফিন না খেলে একটি বল তার হতে পারে।

৩৪#
###
মুক্ত অফিসে নতুন প্রজেক্টের দলিলগুলো নিয়ে বসে রীতিমত হতবাক। অধিকাংশ দলিলই নকল। এগুলো সব বশীর মোল্লা তৈরী করেছে। বশীরের যোগ্যতা আর অসততা অননুমেয়। বশীর মোল্লা সময় জ্ঞানটাও অসাধারন। সে এসে হাজির।

কোন অনুমতি ছাড়া সরাসরি রুমে ঢোকাটা মুক্তর একদম পছন্দ না। কিন্তু বশীরের এই ব্যাবহার মুক্তোর সহ্য করে নিতে হয়। বশীর রুমে এসেই একটি খাম এগিয়ে দেয় মুক্তকে।

বশীর : স্যার এইটা আপনের অংশ। (অদ্ভুদ এক হাসি বশির মোল্লা মুখে।)
বসির : মাশাল্লা দেখবেন এমুন করি করি স্যার আপনেরও গাড়ী বাড়ী ফ্লাট হই যাইব।
মুক্ত : আহ্ চুপ করেন- এগুলো আমি পছন্দ করি না
বশির-        আচ্ছা আচ্ছা বুঝচ্ছি। এটা আমার নামে জমা রাখেন। 
মুক্ত-         অর্থ কি দাড়ালো। 
বশির-       আপনি সৎ লোক, আমিতো আমানত রাখতেই পারি। 

বশীর আবারও একটি বিশ্রি হাসি দিয়ে বের হয়ে যায়। মুক্ত নিজস্ব সেলফ এর একটি ড্রয়ারের তালা খুলে। খামটি রাখে। ড্রয়ারটি বন্ধ করে আবার খুলে, খামটি স্পর্শ করে।

৩৫#
###
ছোট বেলায় ঈদের দিনটা হয় খুব সুখের। মুক্তরও তাই ছিল। নতুন জামা, মজার খাবার, কিছুটা বাধাহীন ঘুড়ে বেড়ানো আর অনেক সালামি। এক ঈদে মুক্তর জমে ছিল ২৭ টাকা। সেদিন বিকেলে বাড়ী ফিরে মুক্ত দেখে মা উঠানে কাজ করছে। মুক্ত খুব সাবধানে শোবার ঘরে যায়। তার বিছানার তোষক তুলে। সেখানেই সে তার জমানো টাকা লুকায়। পাঁচ পয়স, দশ পয়সা, পচিশ পয়সার মুদ্রা সহ এক টাকার নোটও আছে। অনেক টাকা। সেই ঈদে মুক্ত কিছু টাকা তোষকের নিচে রেখে বাকিটা পকেটে রাখে। কারন মা জানতে চাইবে কত টাকা পেয়েছে। কিছু একটা বলে পার তো পাওয়া যাবেই। অনেকগুলো টাকা জমেছে। খুব গুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে সেই ভয়ে গোনা হলো না। একবার ছুয়ে দেখলো
মন ভরে। টার্গেট সাতান্ন টাকা, তারপর একটি বল এবং নিজের খেলার স্বাধীনতা।

৩৬#
###
বড় হয়ে যাওয়া মুক্তর বাস্তবতা আর ভালোলাগা আলাদা। বিশ্বাসের বন্ধু কায়সার, বিশ্বাস ও মুক্ত বসেছে মদ্যপান করতে। এই আড্ডাটা ছিল কায়সারের একটি ভাড়া করা বাড়ীতে। সেখানে থাকেনা কেউ। মাঝে মাঝে বসে নানা রকম আড্ডা অথবা পার্টি। কায়সার গান ধরে। খুব বিশ্রি গলা তার। মনে হচ্ছে কেউ ফ্লোরে চেয়ার টানছে।

কায়সার : ‘তোমার জন্য আমার জন্য’
বিশ্বাস: তোমার আর আমার? কি ব্যাপার?
কায়সার : রিয়েলস্টেটর ব্যবসা করো আর আমার তোমার বুঝো না চান্দু! যা করবো নিজের জন্য করবো- নিজের জন্য মানে তোমারেও ভাগ দিতে অইবো। এই ভাবেই ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে তোমর আমার-
বিশ্বাস : খুব ধরলো বুঝি।
কায়সার: ধরে নি ধরাতে হবে। দিয়ে যাও ফেরত পাবে।
বিশ্বাস : তাতে তো হচ্ছে না। দিয়েই যাচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি। ইনভেস্টমেন্টের কমতি নাই। ফেরত আসার লক্ষণ তো দেখতাছি না!!
কায়সার : দেখবা দেখবা- সবুর কর সবুরে মেওয়া ফলে।
বিশ্বাস : মেওয়া গাছ লাগাইয়া পানি দিচ্ছি তো দিচ্ছি- ফল দূরের কথা ফুলের দেখা নাই।
কায়সার : এই গত এক সপ্তাহের মধ্যে তোমার দুই দুইটা ফ্লাট বিক্রি কনর্ফাম করলাম- ঐটা কি!
বিশ্বাস: (একটু হাসি দিয়ে) এতে আর কি হয়। কত রকম খরচ।
কায়সার : বন্ধু, পেমেন্ট চাই। পেমেন্ট। কালকে-
বিশ্বাস : হবে বন্ধু- হবে- মুগ্ধ কাল ওর পেমেন্টের চেকটা সই করিয়ে নিও।
মুক্ত : ক্যাশ দিলেই বোধ হয় ভাল হয়।
কায়সার : হ্যাঁ ক্যাশ- ক্যাশ চাই। চেক নিয়া কি বিপদ টাইনা আনুম।যাক বন্ধু তুমি আর খেও না, তোমাকে খুব ঘোলা ঘোলা লাগছে। 
বিশ্বাস: হুম বুঝেছি। খাচ্ছি আমি আর ঘোলা দেখছো তুমি।

কায়সার টলতে টলতে উঠে হাটতে শুরু করে। একবার পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। ঘরের বাথরুমের পাশে একটি আলমারি। কায়সার আলমারীর দরজা খুলে ভিতরে যাবার চেষ্টা করে।

বিশ্বাস-       এই তুই যাচ্ছিস কোথায়? 
কায়সার –      ইটস ওকে ম্যান। বাথরুম যাচ্ছি। হিসি।
মুক্ত –          ভাই ওটা তো আলামারি।

৩৭#
###
বিশ্বাস পুরো বিষয়টি টের পেয়ে বাড়ী ফেরার চিন্তা করে। কায়সারকে নামাতে হবে বাসায়। মুক্তও আছে। দুজন দু পথে। নামতে নামতে হিসাব মিলাচ্ছে। নিচে এসে বিশ্বাস পেছনের বাম পাশে বসে। ড্রাইভার দরজা খুলে কায়সারকে পেছনে ডান দিকে বসার ব্যাবস্থা করে দেয়। এসময় মুক্ত দরচা খুলে সামনের সিটে বসতে গেলে- 

বিশ্বাস: মুক্ত আমি আজ অন্য পথে বাসায় যাব। তুমি একটা ট্যাক্সি খুঁজে নাও। 
মুক্ত : রাত হয়ে গেছে। এই সময় ট্যাক্সি পাওয়া ডিফিকাল্ট। একটু কষ্ট করে মেইন রোড এ নামিয়ে দিয়ে যাও।
বিশ্বাস : আহ্ বলছি না অন্য পথে যাব।

মুক্ত কি করবে ঠিক বুঝে উটতে পারে না। রাত সারে বারোটা। রিক্সা পাওয়াই কঠিন হবে। ট্যাক্সি তো দুরের ভাবনা। এর মধ্যে কায়সার মন্তব্য করে বসে।

কায়সার: হুম, মাগনা মদ খাওয়ার জন্য বসে থাকবে। আবার বাসায় পৌছে দিতে হবে। আগে চলে গেলেই পারে। কথাগুলি মুক্তর কানে আসতেই সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কারন মদ খাওয়াটা তার সখ না। প্রয়োজনেই সাথে থাকতে হয়। কায়সারের এই অপমানে খুব আহত হয় সে। মেনে নিতে পারছিল না কোনভাবে। কায়সার জানালা দিয়ে মাথা বের করে।

কায়সার : রাত বিরেতে এত ঝক্কি না করে একটা গাড়ী কিনে নিলেই পারেন মুগ্ধ সাহেব।
বিশ্বাস : এতো রাতে আর ঝামেলা বাড়িও না। একটু ম্যানেজ করে নেও মুক্ত। ছাড়-ছাড়- গাড়ী ছাড় ফিরোজ।

ড্রাইভার ফিরোজ একটানে গাড়ী নিয়ে ছুটে যায়। মনে হলো চোখের পলকে হাওয়া। সেদিন ফিরোজের অপমান আজ কায়সারের এবং বিশ্বাসের অবহেলা। মুক্ত আর নিতে পারছিল না। মুক্ত কি করবে বুঝে পায় না। রাস্তায় কোন গাড়ী রিকশা মানুষ কিছুই নেই। সেদিন প্রায় সকাল পর্যন্ত মুক্ত ফুটপাতে বসে কাটিয়েছে।

৩৮#
###
ছোট বেলায় মুক্তর একবার খুব জ্বর হয়েছিল। তারচেয়ে বেশী ছিল দুর্বলতা। সে সময় জ্বরের কারন বুঝতে না পারলেও একটু বড় হয়ে বুঝে ছিল। মুক্ত টিপিন পিরিয়ডে কিছু খেত না। কারন বল কেনার জন্য টাকা জমাতে হবে। সেই জ্বর ভুগিয়েছে অনেকদিন।

মুক্তর মা রিতা সারারাত কোলে নিয়ে আগলে বসে থাকতো তাকে। দাদী নামাজ পরে ফু দিয়ে দিতো। বিছানাতেই গা মোছানো, মাথায় পানি দেয়া। মুক্তর আজও মনে আছে সেই মাথায় পানি ঢালার পক্রিয়া। মুক্ত বিছানায় শোয়া থাকতো। মাথাটা বালিশে। মাথা আর বালিশের মধ্য থেকে একটা পলিথিন চলে যেত নিচে রাখা বালতিতে। ঘাড়ের নিচে থাকতো একটা মোটা করে প্যাচানো কাপড়। যেন পানি ঢাললে গড়িয়ে গায়ে না যায়।

একটু পর পর রিতা জানতে চাইতো – বাবা তোমার কি একটু ভালো লাগছে?
মুক্ত সবসময় বলতো – হুম! 

মা একটু কাছ ছাড়তেই মুক্ত তোষক উচু করে জমানো টাকাগুলো দেখতো। বহুবার সে ভেবেছে একটু গুনে দেখি কিন্তু গোনা হয়নি।
এদিকে মুক্তর বাবা তখন পলাতক। পুলিশ খুজছে হন্নে হয়ে। মামলা হয়েছে চুরীর। ম্যানেজার সবাইকে জানিয়েছে এর পরের মামলা হবে মাডার কেসের। এদিকে মুক্ত অসুস্থ।

এক সকালে। তখন শীত প্রায় শেষ। চারদিকে কুয়াসা ঢাকা। স্বাধীন ছেলেকে দেখতে বাড়ী ঢুকছে। এতো ভোড়ে কেউ টের পাবে না সেই আশায়। ভেবে রেখেছিল আলো ফোটার আগেই বাড়ী থেকে বের হবে। করছিলও তাই। ওদের বাড়ী মূল গেটটা ছির কাঠের। কাঠের গেট ঠেলে বেড়িয়ে একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে সোজা হেটে রাস্তার মাথায়। এরপর একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে রিতাকে দেখলো। রিতা দাড়িয়ে ছিল গেটেই। রিতা চোখে স্বাধীন খুব অস্পস্ট। কুয়াসা চারদিকে।

কিছু দূর এগেতেই কুয়াসার আড়ালে স্বাাধীন দেখতে পায়, পথ আগলে দাঁড়িয়ে ক’জন পুলিশ। সিদ্ধান্ত নেয় অন্য পথে যাবার, ঘুরে পা বাড়ায়। দেখে, সে পথেও পুলিশ দাঁড়িয়ে। অসহায় স্বাধীন সেদিন পথ খুঁজে পায়নি।

৩৯#
###
অফিস ঢুকতে মুক্তর খুব দেরীই হলো। অফিসে ঢুকেই শুনলো বিশ্বাস তাকে খুজেছে কয়েকবার। আগের রাতের ঝক্কি সামলে দুপুর করে ফেললো। বাড়ী ফিরে মুনার সাথেও খুব তর্কে জড়াতে হয়েছে। একটা লিভ এপ্লিকেশন প্রিন্ট আউট দিল। এই কাগজ আনতে আবার যেতে রুমের বাহিরে। প্রায়ই রুমের প্রিন্টার কাজ করে না। রুমের বাইরে আসতেই একাউন্ডস ম্যানেজার রফিক ছুটে আসলো।

একাউন্ডস: মুক্ত স্যার, আজ বিশ্বাস স্যার আপনাকে বার বার খুজেছে।
মুক্ত: হা। শুনেছি।
একাউন্ডস: স্যার, আমরা যদি একটু সময়মত অফিস না থাকি-
মুক্ত: এখানে আমার পোষ্ট কি জানেন?
একাউন্ডস: জি স্যার। প্রোজেক্ট ডিরেক্টর।
মুক্ত: আর কিছু বলবেন।
একাউন্ডস: জি না স্যার। তবে স্যার, আমি বিশ্বাস স্যারকে বলেছি যে আপনার চেয়ে সিনসিয়ার লোক পাওয়া কঠিন।

মুক্ত কাগজটি হাতে নিয়ে একবার রফিকের দিকে তাকায়। কি বলবে তাকে ঠিক বুঝতে পারে না। 
মুক্ত: রফিক সাহেব নিজের কাজ করুন।

একাউন্ডস: জি স্যার। স্যার আর একটা কথা।
মুক্ত: জি বলুন।
একাউন্ডস: স্যার, আপনার রুমে টেবিলের ড্রয়ারে অনেক টাকা রাখা। এভাবে অফিসে ব্যাক্তিগত সম্পদ না রাখা ভালো।
মুক্ত: সেটা আপনি দেখলেন কি করে? ড্রয়ার তো লক করা।
একাউন্ডস: কই স্যার নাতো। খোলা ছিল। আমি দেখে লক করেছি।

মুক্ত কি বলবে বা করবে কিছুই বুঝে পায় না। রাগ ক্ষোভ সব মিলিয়ে নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছিল। বশীর কত টাকা রেখে গেছে তা গুনে দেখা হয়নি। কথা না বাড়িয়ে মুক্ত রুমের দিকে এগাতে থাকে। পিছন থেকে রফিক সাহেব জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে-

একাউন্ডস: স্যার, টাকা টা গুনে দেখবেন ঠিক আছে কিনা। অনেক টাকা তো-

৪০#
###
টাকার প্রয়োজন মুক্ত বোঝে। সাথে লোভের ফলাফলটাও বোঝে। মুক্তর বাবা যখন পলাতক তখন দেখেছেন সে মুক্তর মায়ের সংগ্রাম। দেখেছে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্ট। মুক্ত তখন জ্বর সেরে উঠেছে মাত্র। স্কুলেও যাচ্ছে। একদিন রিতা আলমারি খুলে টাকা খোজার চেষ্ট করে। পুরো আলমারীতে একটি টাকা নেই। অবশেষে চোখ পরে হাতের একমাত্র  সোনার চুড়িটির দিকে। এই চুরীটি তার একমাত্র বিয়ের উপহার। শ্বাশুরী হাতে দিয়েছিল বাসর রাতে। 

রিতা ঘর পরিষ্কার করতে গেলে, বিছানার চাদর ঠিক করার সময় দু-তিনটে পয়সা মাটিতে পরে যায়। তোষক সরিয়ে দেখে অনেক পয়সা, টাকাও আছে কিছু। গুনে দাড়ালো একশত তের টাকা। রিতা ঠিক বুঝে উটতে পারে না কই থেকে এলো এতো টাকা? কে রাখলো? মনে মনে বেশ খুশীই হলো। আপাতত সমস্যাতো মিটলো। ঘরে এসে এভাবে এতো টাকা তো আর বাইরের লোক রাখবে না। বেশ ক’দিনের বাজার খরচ হয়ে যাবে এ টাকায়।

মুক্ত তখন স্কুলে। সেদিনও ছুটি হলে বন্ধুরা যখন নানা কিছু খাচ্ছে, মুক্ত তখন পকেটে হাত দিয়ে পয়সাটা অনুভব করে চলেছে। স্কুল সেরে বাড়ী ফিরেই এক দৌড়ে ঘরে। 

রিতা: মুক্ত স্কুল শেষ।
মুক্ত: হ্যা মা।
রিতা: কাছে আয়।
মুক্ত: মা আসছি, একটু

বইগুলি বিছানায় রখে টিফিনের পয়সা তোষকের নিচে রাখতে গিয়ে দেখে একটি পয়সাও নেই। হতভম্ব হয়ে যায় মুক্ত। খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় এসে রেললাইনের পরিত্যক্ত পাত দিয়ে তৈরী পিলারে হেলান দিয়ে বসে। চোখে জল ছলছল করছে। 

রিতা : মুক্ত হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেতে আসো

মুক্ত বসেই থাকে। মা আবারও ডাকে। মুক্ত সাড়া দেয় না। এবার রিতা কাছে আসে। হাতে একটি প্লেট, তাতে শীতের পিঠা। মুক্তর মুখের দিকে তাকিয়ে রিতা ভয় পেয়ে যায়। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর নেই।

রিতা : কি হয়েছে আমার সোনা মানিক! কেউ মেরেছে?

মুক্ত কোন কথা বলে না। দু চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে।

রিতা : তোমার জন্য পিঠা বানিয়েছি। খেজুরের গুড়ের পিঠা। নেও খাও-

মুক্ত আজকের টিপিনের পয়সা দুটো হাতের মুঠোয় রেখেছিল।পয়সা দুটো উঠোনে ছুড়ে ফেলে।

রিতা : কি হলো! পয়সা ফেলতেছ কেন! টিফিন খাও নাই!

মুক্ত কথা বলে না। কেদেই চলছে।

রিতা : সোনা মানিক আমার কি হইছে?
মুক্ত : আমার পয়সাগুলি কে যেন নিয়ে গেছে।

রিতা সব বুঝতে পারে। কি বলবে এই বাস্তবতায়। ভাত আর সাধের পার্থক্য এই অবুঝ শিশুকে সে কিভাবে বুঝাবে।

রিতা : কোথায় পাইছো এতো পয়সা?
মুক্ত : টিফিনের পয়সা জমিয়েছে। (খুব ফুপিয়ে উত্তর দেয়)।
রিতা : টিফিনের পয়সা! কেন
মুক্ত : বল কিনার জন্য- আমার সব পয়সা চুরি হয়ে গেল।

মুক্ত এবার চিৎকার করে কাদতে থাকে। রিতা মুক্তকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুক্তর কান্না বেরেই যাচ্ছে। রিতা মাথা বুলিয়ে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে।

রিতা :   ধৈর্য্য ধর বাবা আমি তোমাকে বল কিনে দেব। 
মুক্ত-        কিন্তু আমার পয়সা কে নিল। বাবা বাবা আমার বাবা কোথায়? 
রিতা-       বলছিতো বাবা, বল কিনে দিবো। আর কাদতে হবে না।
মুক্ত:   আমার পয়সাগুলো কোথায় যাবে?
রিতা : আমি তোমায় বল কিনে দিবো। এইবার পিঠা খাও। আমি দেখবো তো বলেছি।
মুক্ত   :      না।

 

Facebook Comments Box

Posted ১:৪১ পিএম | মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।