নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 120 বার পঠিত
এখনো শহরের দেয়ালে দেয়ালে স্থির হয়ে আছে ঝলমলে বিস্ফোরণগুলো। দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো গ্রাফিতি—নতুন প্রজন্মের ভাব ভাষা, আকাঙ্ক্ষা। কবে কে ভাবতে পেরেছিল, এ শহরে এত এত তরুণ–কিশোর প্রতিভাবান শিল্পী বসবাস করে! দৃশ্যপটে না থাকা এই প্রজন্ম উপযুক্ত সময়ে দৃশ্যমান হয়ে জানান দিয়েছে, ‘শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন।’ আমরা দেখতে পেলাম, এই হাঁসফাঁস লাগা শহরের দেয়ালগুলো শিগগির ভাষা পেয়ে গেল। পুরোনো রাজনীতির পুরোনো কথা থাক বলে শহরের সমস্ত দেয়ালে হেসে উঠল।
আমরা বলতে পারি, দেয়ালগুলোকে এখন রঙিন–আকর্ষণীয় দেখায়। অনেক রকমের ছবি আঁকা, বলতে পারি, অনেক কথা লেখা রয়েছে। কী কথা, কী লেখা, তা যদি এক দিনও মন দিয়ে না দেখে, না পড়ে থাকি, তরুণ প্রজন্ম তাদের ভালোবাসা, আবেগ–অনুভূতি কাদের উদ্দেশে নিবেদন করেছে?
দেশটা বহুবার রূপবদলের আশায় বুক বেঁধেছে। প্রতি বদলের পর নিজ নিজ আশাকেই বড়, বিশেষ করে দেখেছি। যুগের পর যুগ ধরে চেয়েছি দেশের ভালো। সে ভালো কেউ করে দেবে, নাকি নিজ নিজ উদ্যোগ, নিজেদের চেষ্টাও থাকতে হয়?
যদি দেয়ালের ভাষা চোখ আর মন দিয়ে দেখতাম, অনুভূত হতো, আমাদের, অর্থাৎ যারা পুরোনো, বড়—সবাইকেই একটু বদলানো দরকার। পুরোনো মানুষেরা পুরোনো, অভিজ্ঞ, সে গৌরবে গোঁফে তা দিয়ে জীবন কাটান। ধ্যানধারণা, ভাব ও ভাষার ধরন না বদলালে নতুন কাল, নতুন প্রজন্ম মনোযোগ দেওয়ার মতো মানুষ বলে ভাববে না।
আমরা কারও কোনো কথা মনমতো না হলে ছ্যাঁৎ করে উঠি, রুষ্ট হই, জবাবের ভাষা শ্লেষাত্মক হয়। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই অস্বাভাবিকতা বিদ্যমান। দ্রুত উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, আচমকা বিরক্ত হওয়া, ক্রোধে কাউকে অপমান করার তাড়নায় ছটফট করা—এ রকম অদ্ভুত স্বভাব বয়ে বেড়াই।
শোধরানোর ধারণা, শোধরানোটা জরুরি, তা মাথায় আসবে কী করে! মানুষের মাথা–মগজ রোজই নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। টেলিভিশন দেখতে বসলে, সংবাদ পরিবেশনা বা আলোচনা অনুষ্ঠান, পত্রিকার ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের ভাষায়, এমনকি রাজপথের আন্দোলনে ভাব–ভাষা প্রয়োগের সময় উচিত–অনুচিত ভেবে দেখা হয় না।
দেশে একটা বদল এসেছে। বড় দোষ করা অসংখ্য মানুষের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে সাধারণ মানুষ। এখন বিস্তারিত কতটুকু জানার সুযোগ মেলে? তথ্যপ্রমাণ ও দায়িত্বশীলতা বাদ দিয়ে গল্প বলা হয়। সে গল্পের ভাব–ভাষা গিবত গাওয়ার মতো হয়ে যায়। আমরা যে যা করছি, তার মূল লক্ষ্য জনপ্রিয়তা, বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো। এই পৌঁছানোর চেষ্টা নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ের মতো। আমাদের কূল ভাঙছে। গড়ে উঠছে যে কূল, তা কেমন? ভেবে দেখা দরকার মনে হচ্ছে না কারও।
আমাদের যৌবনকালে সুন্দর করে কথা বলা অতি জরুরি বলে ভাবা হয়েছে। তার আগেও শুনেছি, তেমনটা ছিল। স্বাধীনতার পরে একটু একটু করে এই রীতি পরিবর্তিত হতে শুরু করে। রাজনৈতিক ভাষার পরিবর্তন দিয়ে এই অধ্যায়ের শুরু। বাড়তে বাড়তে এমনই দশা হয়েছে, রাজনীতি এবং বহু মানুষের ভাব ও ভাষা থেকে সৌন্দর্য প্রায় নির্বাসিত।
রাজনীতির ভাষায় কি বিনয়, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার থাকতে নেই! সম্প্রতি সবাই নিজেদের চোখ দিয়ে দেখেছে, ভাষার দোষে অতি মজবুত সিংহাসন টুপ করে উল্টে গেল। তার পর থেকে সবাই ভাবছে, আহা, বদলে গেছে সব। না, সব বদলে যায়নি। শাসক বদলাল, মানুষ বদলাল না একচুলও—তা কি তাহলে বিশেষ কোনো বদল বলে মনে করা যায়?
আমরা বড়দের ধমক–ধামক, চড়–থাপ্পড় খেতে খেতে বড় হয়েছি। আমাদের সন্তানদের সঙ্গে আমরা ওই চড়–থাপ্পড়, ধমক–ধামকের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখিনি। আমরা মেনে নিয়েছি, শাসন–বারণ থাকবে, কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে ব্যবহার, ভাব ও ভাষা বাবা–দাদার আমলের মতো হওয়া উচিত হবে না। এটাই বদল। নতুন কাল, নতুন মানুষদের স্বীকার করে নেওয়ার বদল।
বড়রা বদলায় বলে ছোটরা স্বস্তিদায়ক একটা পৃথিবী পায়। নতুন–পুরোনোর ঠোকাঠুকি হয় না। না হওয়ার কারণে নতুনকে নিজের জায়গার জন্য ঘরের মধ্যে লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করতে হয় না।
রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই তা করা যেত, দেশ একটুখানি স্বস্তি পেত। দেশের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বহু মানুষেরও মনে হতে পারত, এক জনমে একটা বড় বদল তো দেখে যেতে পারলাম। সংস্কার মানে নিয়মকানুন–রীতি বদলানো। তা কি পুরোনো ভাব–ভাষায় অভ্যস্ত মানুষদের বদলে দিতে পারবে?
অসংখ্য তরুণ মনের ভাবনা ছড়ানো–ছিটানো দেয়ালে দেয়ালে, সারা শহরে। বোঝা যায়, শেখানো বুলি নয়, এসব তাদের মনের কথা। ২০২৪ সালে তারা দেয়ালের সামনে রংতুলি নিয়ে দাঁড়ানোর আগে পুরোনো, অধিক কচলানো রাজনৈতিক ভাষা ছাড়া দেয়ালগুলোয় আর বিশেষ কিছু দেখার সুযোগ কি হয়েছে কখনো?
একটা দেয়াললিখন বাড়ির কাছে বলে রোজ দেখি, দেখামাত্র রোজই ধাক্কা খাই। অনুমান করি, লিখেছে হয়তো পনেরো থেকে কুড়ি বছর বয়সী কেউ। তারা আমাদের, মানে বড়দের ভাব ও ভাষা প্রত্যক্ষ করেই কি দেয়ালে বড় করে কথাটা লিখেছে? এটা কি সতর্কবার্তা!
দেয়ালে লেখা ‘স্বাধীন কিন্তু সভ্য নয়’। এই তারুণ্যের বার্তা শুধু পড়া বা দেখার নয়, বিশেষ করে ভাবারও। লেখার মানুষগুলো আমাদের বয়সীদের ভুলো মনের কথা জানে, সতর্ক করে দিতে এক দেয়ালে লিখে রেখেছে, ‘বায়ান্ন ভুলতে পারো নাই, চব্বিশ ভুলবে কেন?’
Posted ৯:৪৫ এএম | সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।