বাংলাদেশ ডেস্ক | শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট | 13 বার পঠিত

দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তে নতুন করে ভোটের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পন্নের কথা জানিয়েছিল তারা। তবে একই দিনে গণভোট আয়োজনে খরচ কমানোর যুক্তি দেওয়া হলেও ২০ ভাগ ব্যয় বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ইসির সাবেক কর্মকর্তারা।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একই দিনে দুই নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময় তিনি ব্যয় সাশ্রয়ের কথাও তুলে ধরেছেন। তবে একই দিনে গণভোট করতে ইসির সার্বিক নির্বাচনী প্রস্তুতিতে কাজ অনেক বেড়ে যাবে। খরচ কিছুটা হলেও বাড়বে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ভোটকক্ষ এবং ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা বাড়াতে হবে কিনা এ নিয়েও তাদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন মত।
তবে ইসি কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, গণভোট নিয়ে কমিশনের মধ্যে কোন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়নি। তাই এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।
ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, গণভোটের জন্য পৃথক ব্যালট পেপার ছাপানো এবং ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বাইরে খরচ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। তবে ইসি নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তাদের মতে, প্রশিক্ষণ ব্যয়ের পাশাপাশি ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ বাড়ানো লাগতে পারে। এর বাইরে পৃথক ব্যালটের পাশাপাশি পৃথক ব্যালট বাক্সেরও প্রয়োজন হবে। সব মিলিয়ে নির্বাচনী বাজেট ২০ ভাগ বেড়ে যেতে পারে।
এর আগে ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য ইসির নির্ধারিত কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৭৬১টি। পুরুষদের জন্য এক লাখ ১৫ হাজার ১৩৭ এবং নারীদের জন্য এক লাখ ২৯ হাজার ৬০২ ভোটকক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছিল। মোট বুথের সংখ্যা দুই লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৯টি। একটি নারী কক্ষে (বুথ) ৫০০ ভোটার, পুরুষ কক্ষে ৬০০ ভোটার এবং একটি কেন্দ্রে তিন হাজার ভোটার ভোট দেবেন এমন হিসাব করে কেন্দ্র এবং কক্ষ বিন্যাস করা হয়েছিল।
একাধিক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, একটি বুথে একজন সহকারী প্রিসাইডিং এবং দুইজন পোলিং অফিসার সাধারণত দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় সরকারের ভোটেও সমানসংখ্যক কর্মকর্তা দিয়ে তিনটি ব্যালটে ভোট নেওয়া হয়। এখানে শুধু দুটি ব্যালটে ভোট হবে। তাই গণভোটের জন্য অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছাপানো ছাড়া অন্য কোনো খরচ হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের মতে, পৃথক ব্যালট বাক্সেরও প্রয়োজন নেই। কারণ স্থানীয় সরকারের ভোটে সাদা, গোলাপি এবং সবুজ তিনটি ব্যালট একই বাক্সে রাখা হয়। ভোট গ্রহণ শেষে ব্যালট পেপারগুলো আলাদা করে গণনা করা হয়। এখানেও জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট এবং গণভোটের ব্যালট দুই রঙের করা হলে, পৃথক ব্যালট বাক্সেরও প্রয়োজন পড়বে না।
তবে কেউ কেউ বলছেন, এবার ইসি সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বুথে গড়ে ১০০ ভোটার বাড়িয়ে ৪৯ হাজার বুথ এবং দেড় লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা কমানো হয়েছিল। গণভোট যেহেতু অপ্রচলিত এবং বেশির ভাগ ভোটারের জন্য নতুন ধারণা, এ ক্ষেত্রে ভোট দিতে সময় কিছুটা বেশি লাগতে পারে। তাই এই বুথ কমানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই খরচ ২০ ভাগ বেড়ে যাবে।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তাদের মতে, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিলেও গণভোটে আয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিধিমালা জারি হওয়ার পরে এ বিষয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু করবে ইসি সচিবালয়।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর একই সঙ্গে দুই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইসির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। তাই চলতি সপ্তাহেই এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে নতুন অধ্যাদেশ জারি হবে বলে ইসিসংশ্লিষ্টদের ধারণা।
দেশে ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনটি গণভোট হয়েছে। তবে কখনও জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয়নি। গত দুটি গণভোটে সম্পৃক্ত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের এমন দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জামাদি বাড়াতে হবে গণভোটে। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে।
তাদের মতে, সংসদ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা থাকবে প্রার্থীদের, আর গণভোট নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর বিষয় রয়েছে। গণভোটের প্রচার ইসির পক্ষ থেকে চালাতে হবে। একই দিনে ভোটের সময় সংসদ ও গণভোটের যেমন ব্যবস্থপনার বিষয় রয়েছে, তেমনি গণনার ক্ষেত্রে কোনটি আগে, কীভাবে করবে, তা নির্ধারণের বিষয় রয়েছে। আর গণভোটের ফলাফল গণনার সময় লাগবে বেশি।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জেনে কমিশন বৈঠকে আলোচনা করে এ নিয়ে মতামত দেবেন।
সংসদ নির্বাচনের জন্য পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় রেখে ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা ছিল ইসির। প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষের জন্য ৯ থেকে ১০ লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা আর সাত থেকে আট লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে ভোটে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ ধাপের সংলাপ চলছে।
গণভোটে ব্যয় কত
আগের সব গণভোটের উদাহরণের ভিত্তিতে বিশ্লেষকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে করলে এজন্য অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হতে পারে। পৃথক সময়ে গণভোট আয়োজন করা হলে এই খরচ সংসদ নির্বাচনের ব্যয়ের প্রায় কাছাকাছি দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হতো। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনে এবার দুই হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোটে দায়িত্ব পালন করেন। এ দুই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে গতকাল বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মতোই গণভোটের প্রস্তুতি নিতে হয়। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র, ভোটকক্ষ স্থাপন, ব্যালট বাক্স, নির্বাচনী সামগ্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য সমানই প্রয়োজন হয়। গণভোটে শুধু ব্যালট পেপারে ভিন্নতা, প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের বিষয় আলাদা থাকে।
দেশে প্রথম গণভোট হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে। ১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই ইসির তৎকালীন গণভোট প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই গণভোটে ২ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এর চার বছর আগে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যাতে ব্যয় হয়েছিল ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর পর ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দ্বিতীয় গণভোট হয়। এতে তৎকালীন ইসির ব্যয় হয় ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর পরের বছর ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। আগের দুই সামরিক শাসনামলে হলেও ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয় গণভোট হয় নির্বাচিত সরকারের অধীনে; দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন বিলে সম্মতি রয়েছে কিনা এ প্রশ্নে।
এ প্রসঙ্গে জেসমিন টুলী আরও বলেন, ১৯৭৭ সালে গণভোটের সময় ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৩ লাখ। এতে ব্যয় হয় ২ কোটি ৫ লাখ টাকা। ১৯৮৫ সালে ৪ কোটি ৮০ লাখ ভোটারের গণভোটে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। ইসির আনুষ্ঠানিক তথ্য না থাকায় ১৯৯১ সালে ৬ কোটি ২২ লাখ ভোটারের গণভোটে সাড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি হয় বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
১৯৯১ সালের তৃতীয় গণভোটের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসির সাবেক কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, গণভোট করতে হলে বর্তমান ভোটকেন্দ্র ৪০ হাজার হলে ২ লাখ ৫০ হাজার, অর্থাৎ আড়াই লাখ স্বচ্ছ ব্যালট বক্স ব্যবহার হবে। একই দিন গণভোট হলে দ্বিগুণ মোট ৫ লাখ ব্যালট বক্স প্রয়োজন হবে। পরবর্তী সময়ে এই অতিরিক্ত আড়াই লাখ স্বচ্ছ ব্যালট কোনো কাজেই লাগবে না, বরং সংরক্ষণে আলাদা জায়গা লাগবে।
তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ব্যয় ২০ ভাগ বৃদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত খরচ হবে ফরম প্যাকেটের সিল তথা নির্বাচন মালপত্র, ব্যালট পেপার মুদ্রণ ও অতিরিক্ত এক কপি ছবিসহ ভোটার তালিকা ছাপাতে।
Posted ৪:৪৪ পিএম | শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।