নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 121 বার পঠিত
গায়ের জোরে কিংবা বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। রাজনীতিও হয় না। আওয়ামী লীগ সরকার তা পারেনি। জনসাধারণের সঙ্গে না থাকলে, জনগণের রায়ের সঙ্গে আপস না করে, উপরন্তু বলপ্রয়োগ করে, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করে চিরদিন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখা যায় না। এটাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মানুষ প্রাণ বিসর্জনের মতো একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে চেতনা এসেছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেখে তারা বিশ্বাস করতে পারছেন, তারা যে পরিবর্তনের আশা করছেন, তার একটা সূচনা সম্ভবত হয়েছে। আর যারা আন্দোলন করেছেন, তারা একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান। বারবার তারা স্পষ্ট করে এটাই বলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার খুব জটিল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে। এ কারণে এই কয়েক মাসে সরকারকে যেসব জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটা হয়তো তাদের নিজেদের ভাবনায় ছিল না।
আর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি কোনো কিছুরই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। সুতরাং জুলাই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলা যায় না। এখন অনেকে বলছে, এখানে কিছু ভুল ছিল। কেউ বলছে একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করা উচিত ছিল। এতে সন্দেহ নেই যে, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা কঠিন লড়াই করেছে, সেখানে বিপ্লবী চেতনা ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল।
আমার বিবেচনায় জুলাইয়ের পুরো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সেটা খুব সংগঠিতও ছিল না। সাধারণভাবে দেশ বদলানোর একটা লক্ষ্য থাকলেও এটাকে লক্ষ্যাভিমুখী আন্দোলন বলা যাবে না। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা কঠিন লড়াই করেছে এবং সেখানে বিপ্লবী চেতনা ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সময়টা অনেক কম। এত কম সময়ের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়ন করাটা যুক্তিসংগত হবে না। সংস্কার একটা বিরাট বিষয়। কেননা, পুরো দেশটাই বদলাতে হবে। নতুন দেশ তৈরি করতে হবে। নতুন ও ভিন্ন ধরনের বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে, মানবিক মূল্যবোধ থাকবে। কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। পাশাপাশি দেশ কীভাবে টেকসই অর্থনীতির রাষ্ট্র হবে সে বিষয়গুলো ভাবতে হবে। আমাদের দেশে বারবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসছে, কারণ আমাদের সংবিধানে এমন কিছু বিষয় আছে যা ফ্যাসিবাদকে সাপোর্ট করে। প্রধানমন্ত্রীর অপরিসীম স্বাধীনতা, কোনো জবাবদিহিতা নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই, জনগণের বলবার জায়গা নেই– এগুলো ছিল। তা ঢেলে সাজাতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন, দেশের সংস্কারের জন্য ঐকমত্য লাগবে। ভাবের দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে, কাজের দিক থেকে, দলের দিক থেকে এমনিতেই বাংলাদেশ অনেক বিভাজিত। এই বিভাজন যদি চলতে থাকে, তাহলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। আমাদের মতগুলো এক করতে হবে। এমন একটি নির্বাচন করতে হবে, যেখানে সবাই আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শেখ হাসিনা এ দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাই নির্বাচন দেওয়া এবং ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি। তবে রাষ্ট্র সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুলিশকে জনবান্ধব করে তুলতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সময়ে পুলিশ যেভাবে অত্যাচার করেছে, যেভাবে গুলি ছুড়েছে, তা অবর্ণনীয়। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশ কোনো কাজই করছে না। তারা নিষ্ক্রিয়। পুলিশ ও আইনব্যবস্থা সক্রিয় না হলে নির্বাচন করা সম্ভব না। তাই পুলিশকে সংস্কার করেই সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। বাংলাদেশকে আবার যারা পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের রুখে দিতে হবে।
সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। কেউ বলতে পারবে না দেশের সবকিছু পরিপূর্ণভাবে ভালো হয়ে গেছে, আর সংস্কারের দরকার নেই। তাই সংস্কার থামিয়ে দিলাম। সংস্কারের জন্য আজীবনই একজন সরকার থাকা লাগবে। এজন্য তাকে ঠিক করে দিতে হবে ‘তুমি এতদূর করো’। আমরা এতটুকু বুঝি নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, গ্রহণযোগ্য হয়, সন্তোষজনক হয়, তার জন্য যে সমতল ভূমি তৈরি করার দরকার তা করে তারা যাবেন। দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথাও কেউ কেউ বলছেন। এ পর্যন্ত আপনি মোটামুটিভাবে মেনে নিতে পারেন। এর পরই নির্বাচনে যাওয়া যাবে। পরে নির্বাচিত সরকার এসে বাকি সংস্কার করবে।
সংস্কারের কথা বলতে গেলে বলতে হয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমেনি। এখন তো সিন্ডিকেট নেই। সমন্বয়কেরাও এখন সরকারকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রশ্ন করছে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছে– ‘এখনও কেন দাম কমছে না?’ সরকারকে এগুলো নিয়েও ভাবতে হবে। মানুষের পেটে আগুন লাগলে, সংস্কার ভালো লাগে না। এই সরকারকে প্রথমে পেটের ক্ষুধা দূর করতে হবে, দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের পর কোনোভাবে এই সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ ব্যর্থ হবে। সরকারকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। বিভিন্ন সহিংস ঘটনা, অপতৎপরতা উদ্বেগের বিষয়। আমি মনে করি এগুলো এক ধরনের সতর্ক বার্তাও দেয়। সম্প্রতি আইনজীবী যিনি মারা গেছেন, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটা হিংসার চূড়ান্ত জায়গা থেকেই করা হয়েছে। এরকম ঘটনা আমরা আমাদের দেশে কম দেখি, আশপাশে দেখি। যেন রেপ্লিকার মতো এ ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা যখন শুরু হয়েছে তখন আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র থেকে তাদের শাসক দল, তাদের মুখপাত্ররা বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা আরও স্পষ্ট ভূমিকা চাই। যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছে, যারা এদেশে সত্যি সত্যি গণতন্ত্রের চর্চা করতে চান এবং তা অব্যাহত রাখতে চান তাদেরকে এই অপতৎপরতা রুখে দিতে হবে। মিডিয়ার ওপর যেভাবে আঘাত আসে তা মানা যায় না। পত্রিকা অফিসের সামনে গরু জবাইয়ের মতো যে বিভৎস কাণ্ড ঘটলো তা ধিক্কারজনক। আমরা পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি। কারণ আমরা গণতন্ত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। সেটা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র কোনোভাবেই না। আপনার কোনোকিছু যদি পছন্দ না হয়, সেটা বলবার ধরন আছে। অস্ত্রের ভাষায়, জিঘাংসার ভাষায় বলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে সরকার কাজ শুরু করবেন তা চাই না। আগে থেকে প্রোঅ্যাকটিভ থাকতে হবে। বিভিন্ন সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার ও সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখন পর্যন্ত প্রোঅ্যাকটিভ তো নয়ই, অ্যাকটিভও নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের একটা সম্মিলিত অবস্থান ছিল। আমরা ৪১ থেকে ৪২টি দল বিগত সরকারের আমলে যে যুগপৎ আন্দোলন করছিলাম, সেখানে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে আমাদের সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী নয়। কিন্তু দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সংস্কারভাবনাগুলো আপডেট করে যেভাবে বলতে হয়, সেটা বলার চেষ্টা করছি। আগে মনে হয়েছিল, সংস্কারের সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এখন কিছু কিছু ক্ষেত্র, যেমন সংখ্যানুপাতিক ভোটসহ কিছু বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সামনে আসছে। আমি, আমার দল ও জোট আমরা সংখ্যানুপাতিক ভোটের পক্ষে পড়েছি। আমরা ছয়টা দলসহ আরও ৪১ টি দলের প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে এটার কোনো ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড নাই। একেক দেশে একেক রকমভাবে করতে পারে। নির্দিষ্ট ক্যানডিডেট বা প্রার্থী থাকবে না। আমি আমার এলাকায় যখন দাঁড়াব তখন নিজের পরিচিতি, গুণাবলি দিয়ে ইম্প্রেস করতে পারি। কিন্তু এখানে এরকম ইনডিভিজুয়াল ক্যাপাসিটিতে ইমপ্রেস করার জায়গা নেই। এখানে একটা তালিকা থাকবে। কোনোকিছুই গোপন থাকবে না। একটা দল যত পার্সেন্ট ভোট পাবে সে অনুসারে ১-২-৩-৪ এমন ক্রমন্বয় থাকবে। যিনি এক নম্বর হবেন তিনি এক নম্বর লিস্টেই থাকবেন। চার নংকে ৫ নম্বরে নিয়ে গেলে এখানে বাণিজ্য করার সুবিধা হবে।
এখানে মিনিমাম পারসেন্টেজ ভোট পাওয়ার কথা থাকে। কোথাও ১ শতাংশ, কোথাও ৫ শতাংশ এর কথা বলা হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দল এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের প্রাপ্ত ভোট যদি দেখেন তা খুব হতাশাজনক। কেউ হয়তো খেয়াল করেন নাই। যদি করতেন তাহলে হতাশ হতেন।
আরেকটি বিষয় হলো সংখ্যানুপাতিক ভোট। এটা ভালো বিষয়। এর জন্য ব্যাপক বোঝাপড়ার দরকার। কেন? এখন যে ভোট হবে কোনো একটা দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে। আমাদের দেশে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি- দুটো বড় রাজনৈতিক দল ছিল। তাদের এভারেজ ভোট ছিল ৩০-৩৫-৩৬ শতাংশ এর মধ্যে। কিন্তু আগের সিস্টেমে ৩৬ শতাংশ ভোটও যদি পান তাহলে এখনকার সিস্টেমে ১৫০ এর বেশি সিট পেয়ে যাবেন। ৩৫ শতাংশ মানে ৩ দিয়ে পূরণ করেন ৩৫কে, তাহলে ১০৫টি সিট পেয়েছেন। আপনি তো সরকার গঠন করতে পারবেন না। তখন কারো সঙ্গে কোয়ালিশন করতে হবে। কোয়ালিশনের জন্য বড় ধরনের বোঝাপড়া দরকার। কোয়ালিশন সরকার টিকবে কিনা সেটাও প্রশ্ন। এর জন্য অনেকগুলো ফর্মও আছে। আমরা সব বিষয়গুলো নিয়ে আদ্যোপান্ত ভেবে এখনো কথা বলি নাই। আমাদের নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা, মত আদান প্রদানের দরকার, নিজেদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করা দরকার তাও করা হয়নি। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছি। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শক্তির যে ভারসাম্য আছে তাতে এই ভোটে ইমব্যালেন্স তৈরি হবে। হয়তো অনেকের উত্থান হবে, যাদের আমরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি না। তবে আশা রাখি, গণতন্ত্রের পথে দেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবে।
Posted ৫:২৯ এএম | বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।