নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | প্রিন্ট | 121 বার পঠিত
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে রীতিমতো ‘ধ্বংস’ হয়ে গেছে। এত ব্যাংক লুট বিশ্বের কোথাও হয়নি। নজিরবিহীনভাবে পাচার হয়েছে এসব টাকার সিংহভাগ। আশঙ্কাজনভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এতে অতি মাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছে গোটা ব্যাংক খাত। এরপর থেকেই দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে শুরু হয় ‘রক্তক্ষরণ’। যা এখনো অব্যাহত।
এসব নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছেন ব্যাংক ও অর্থনীতি সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর-ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। তাদের নীতিগত ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ব্যাংক দখল, লুট, বড় বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। ব্যাংক বিনাশে আওয়ামী দুষ্কর্মের এই তিন দোসর ‘শিক্ষিত তস্কর’ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তাদের বিচারের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। আলোচিত রিজার্ভ চুরিসহ অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রথম সুযোগ করে দিয়েছেন ড. আতিউর রহমান। তিনি সরকারের পতনের আগেই দেশত্যাগ করেন। ফজলে কবিরের আমলে আতিউরের প্রণীত নীতির মাধ্যমে অপকর্মের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। শুরু হয় ব্যাংক দখল। আর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে অর্থনীতি ও ব্যাংকে নজিরবিহীন লুটপাট ও টাকা পাচারের ঘটনা ঘটে। এমনকি তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ব্যাংক দখলে সহায়তা করেন।
আতিউরের আমলে নানা অপকর্ম শুরু
ড. আতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১ মে থেকে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত পেয়েছিলেন। কিন্তু অদক্ষতা, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বকীয়তাকে খর্ব করা, ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ায় খাতটি দুর্বল হতে থাকে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলেন, পরিদর্শনব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেন, ব্যাংক লুটপাটের সুযোগ করে দেন। তার সময়ে নীতিমালার শিথিলতায় শুরু হয় জালিয়াতি। ওই সময়ে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্সের জালিয়াতি প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দেওয়া নয় ব্যাংকের কোনোটিই দাঁড়াতে পারেনি। অপরিকল্পিত ও অদক্ষ আইটি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণের কারণে রিজার্ভ চুরির সুযোগ তৈরি হয়।
২০১০ সালের শুরুতে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি হয়। দুটি ব্যাংকে বড় জালিয়াতি হলেও আতিউরের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। তার সময়ে লুটপাটকারীদের নজর পড়ে জনতা ব্যাংকে। দুর্বল তদারকির পাশাপাশি প্রচলিত নীতিমালাগুলো শিথিল করে লুটাপাটকারীদের আরও বেশি সুযোগ করে দেন।
২০০৯ সালের ১৯ এপ্রিল শিল্প খাতের খেলাপি ঋণ ডাউন পেমেন্ট ছাড়া নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে নির্বিচারে ঋণখেলাপিরা এর সুযোগ নেন। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। এতেও ক্ষান্ত হননি ঋণখেলাপিরা। তারা আরও ছাড় নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে ২০১২ সালের ১৪ জুন খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমানো সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালের ১৯ মে খেলাপি ঋণ নবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেখানে বলা হয়, প্রথম দফায় ২ বছর, দ্বিতীয় দফায় এক বছর এবং তৃতীয় দফায় ৬ মাসের জন্য নবায়ন করা যাবে।
২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাড় দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি খেলাপি ঋণ নবায়নে বড় ছাড় দেওয়া হয়। এতে ৫০০ কোটি টাকা এবং এর বেশি মেয়াদি ঋণ ১২ বছর ও চলমান ঋণ ৬ বছর মেয়াদে নবায়ন করার সুযোগ আসে। কিস্তির ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই এ সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যাংকের ‘কস্ট অব ফান্ড’-এর সঙ্গে ১ শতাংশ সুদ যোগ করে সুদ নির্ধারণের কথা বলা হয়। এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হলেও তা চলমান থাকে। আগে খেলাপি ঋণ ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য নবায়ন করা যেত। এ নীতিমালার ফলে বেক্সিমকো গ্রুপসহ সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগ্রুপগুলো দফায় দফায় খেলাপি ঋণ দীর্ঘমেয়াদে নবায়ন করেছে।
২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাড় দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি খেলাপি ঋণ নবায়নে বড় ছাড় দেওয়া হয়। এতে ৫০০ কোটি টাকা এবং এর বেশি মেয়াদি ঋণ ১২ বছর ও চলমান ঋণ ৬ বছর মেয়াদে নবায়ন করার সুযোগ আসে। কিস্তির ১ থেকে ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই এ সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যাংকের ‘কস্ট অব ফান্ড’-এর সঙ্গে ১ শতাংশ সুদ যোগ করে সুদ নির্ধারণের কথা বলা হয়। এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য দেওয়া হলেও তা চলমান থাকে। আগে খেলাপি ঋণ ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য নবায়ন করা যেত। এ নীতিমালার ফলে বেক্সিমকো গ্রুপসহ সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগ্রুপগুলো দফায় দফায় খেলাপি ঋণ দীর্ঘমেয়াদে নবায়ন করেছে।
২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি বড় অঙ্কের ঋণ নীতিমালা শিথিল করা হয়। ফলে বড় গ্রাহকরা বেপরোয়া গতিতে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে আতিউর আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তির সংস্থা সুইফটের সঙ্গে আরটিজিএস-এর সংযোগ দিয়েছিলেন। যাতে ব্যাংকগুলো অনলাইনে লেনদেন করতে পারে। এতেই রিজার্ভ চুরির পথ সুগম হয়। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমসের নিউইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে এখনো ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। অপরিকল্পিত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা ও সম্প্রসারণের কারণেই ওই চুরি হয়েছিল। ড. আতিউরের সময় ব্যাংকের সব সূচকে অবনতি ঘটে। গভর্নর হওয়ার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। পদত্যাগের সময় ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
Posted ৫:২২ এএম | সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।