| বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 77 বার পঠিত
রবীন্দ্রনাথের জীবন–কথা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছে বিশেষ একটি নাম । বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তাঁর বিশাল সাহিত্য কীর্তির জন্য তিনি বহু বাঙালির রক্তস্রোতে আজও মিশে আছেন।
তিনি ছিলেন একাধারে বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকাকার, ছোটগল্পকার, প্রান্ধিক ও দার্শনিক। এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ঘটেছিল তার বর্ণময় দীর্ঘ কর্মজীবনে।
তবুও তাঁর কবি পরিচিতিই তাঁকে বিশ্ববরেণ্য করে তুলেছিল আর তাই রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত করা হয়েছিল ’বিশ্বকবি’ বা ’কবিগুরু’ নামে। আর তাঁর কবিতাগুচ্ছের জন্য তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
তোমরা অনেকেই হয়তো জানো প্রথম বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। শুধু তাই নয়, তিনিই একমাত্র অ-ইউরোপীয় প্রথম নোবেলজয়ী। বাংলা সাহিত্যেও এখন পর্যন্ত এ পুরস্কার আর কেউ পাননি। সে-ও শতবর্ষ পাড় হয়ে যাওয়া আগের কথা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে ভারতের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা সারদা দেবীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্দশ সন্তান। জন্মের সময় তার ডাক নাম রাখা হয় রবি।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেছেলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।
১৮৭৩ সালে যখন তার ১১ বছর বয়স তখন তিনি কয়েক মাসের জন্য বাবার সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল শান্তিনিকেতনে দেবেন্দ্রনাথের নিজস্ব সম্পত্তি, অমৃতসর এবং পাঞ্জাবে হিমালয় পাহাড় ঘেরা ডালহাউসি শহরে । সেখানে থাকাকালীন বাবার কাছে তিনি সংস্কৃত, ইংরিজী, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত অধ্যয়ন করেন। এ বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম গান “গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বাল”। তখন তিনি তার বাবার সাথে নিয়মিত স্বর্ণমন্দিরে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ তার ’জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, সেসময় মন্দিরের ভজন সঙ্গীত তাঁর ওপর বড়ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা মারা যান। পিতা দেবেন্দ্রনাথ বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে থাকতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল গৃহ ভৃত্যদের শাসন ও সান্নিধ্যে।
১৮৭৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম ছোট গল্প এবং নাটক লেখেন। এর আগেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত কাব্যের জন্ম দিয়েছিলেন মাত্র ৮ বছর বয়সে। যা ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। সে কবিতা পরে ছাপাও হয়েছিল একটি পত্রিকায়। একই বছর তিনি লিখেন ভিখারিনী যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোট গল্পের মর্যাদা লাভ করেছে ।
১৮৭৮ সালে সতের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে যান। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনি আইনজ্ঞ হন। প্রথমে তিনি সমুদ্রতীরের শহর ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছর পরে লন্ডনে আসেন আইনবিদ্যা নিয়ে পড়তে। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি শেষ করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে তিনি সেক্সপিয়র সহ অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রায় দেড় বছর অর্থ্যাৎ ১৮৮০ সালে তিনি আইনের পড়া শেষ না করেই কলকাতা ফিরে আসেন।
১৮৮৩ সালে ১০ বছরের কিশোরী মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। জন্মের সময় মৃণালিনীর ডাক নাম ছিল ভবতারিণী এবং তিনি ছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক অধস্তন কর্মচারীর মেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়েছিল যাদের মধ্যে ২ জন শিশুবয়সেই মারা যায়।
১৮৯০ সাল থেকে বাবার আদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, সেইসঙ্গে রাজশাহী ও উড়িষ্যায় পৈত্রিক জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা শিলাইদহে তাঁর সাথে যোগ দেয়। সেই সময় জমিদার বাবু নামে পরিচিত পান রবি ঠাকুর।
১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাটিয়েছিলেন শিলাইদহে। সেখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, ক্ষনিকা ও চৈতালির অসংখ্য কবিতা। গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদের কাজও তিনি শুরু করেছিলেন শিলাইদহে।
রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই বলেন এসময় প্রজাদের কল্যাণে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালিন তিনি প্রজাদের কল্যানে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। ওই সময় তিনি তাঁর গল্পগুচ্ছ বইয়ের প্রায় ৫০টির মত গল্প লেখেন। এসব গল্পে তিনি মূলতগ্রাম বাংলা দারিদ্র ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছিলেন।
এরপর সপরিবারে যান পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে । শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটি ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯০১ সালে যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯২১ সালে। এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
শান্তিনিকেতনে থাকাকালেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাকে হারান। ১৯০৫ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান।
১৯০৫ সালে এসবের মধ্যেই তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক লর্ড কার্জন যখন দেখলেন বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে , তখন তারা ওই আন্দোলন রুখতে সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাকে দুভাগে ভাগ করে দিতে। এর প্রতিবাদে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল তার পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তখন শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কলম ধরে যে গানগুলো লিখেছিলেন, তা তখন এক অভিনব উন্মাদনা তৈরি করেছিল।
১৯১৩ সালের নভেম্বর ১৪ তারিখে প্রথম বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ’নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল সাহিত্যসম্ভারের যেসব হিসাব পাওয়া যায় সে অনুযায়ী তিনি লিখেছিলেন ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ এবং অন্যান্য আরও গদ্য, ৯৫ টি ছোটগল্প এবং দুহাজারের ওপর গান।
প্রায় ৭০ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেন। ছবি আঁকায় তাঁর কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। লেখার কাটাকুটিকে একটা চেহারা দেবার চেষ্টা থেকে তাঁর ছবি আঁকার শুরু। তারপরেও তিনি প্রায় দু হাজার ছবি এঁকেছিলেন।
ঠাকুরের ভ্রমনের নেশা ছিল অনেক। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশী দেশ ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো সফরেরই উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বাইরে এবং অবাঙালি পাঠক এবং শ্রোতাদেরকে তার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া এবং তার রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করা।
জীবনের শেষ চার পাঁচ বছর ধারাবাহিকভাবে নানা অসুস্থতায় ভুগেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু লেখা তিনি কখনও থামাননি। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই তাঁর জীবনাবসান হয়।
রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানই তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত গান ‘ আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের আর ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীত।
Posted ১:৪০ পিএম | বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
| admin
এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।