মঙ্গলবার ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

ইতিহাসে কতখানি ঘটে সত্যের প্রতিফলন?

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   136 বার পঠিত

ইতিহাসে কতখানি ঘটে সত্যের প্রতিফলন?

কী করিয়া ইতিহাস ও কাহিনি রচনা করা হয়, তাহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাহিনি’ নাটকের ‘ভাষা ও ছন্দ’-এর মধ্যে দারুণভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। উহার একটি অংশে দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে রামের উপর মহাকাব্য লিখিতে বলিলেন। উত্তরে বাল্মীকি বলিলেন, তিনি রামের কীর্তিগান শুনিয়াছেন, কিন্তু সকল ঘটনা জানেন না। সুতরাং সত্য ইতিবৃত্ত তিনি কীভাবে লিখিবেন? সেই কারণে বাল্মীকি মনে করিতেছেন যে, সত্য হইতে তাহার বিচ্যুত হইবার ভয় রহিয়াছে। বাল্মীকির এই সরল উক্তি শুনিয়া দেবর্ষি নারদ একটি গূঢ় সত্য উচ্চারণ করিলেন। কবির ভাষায়- ‘নারদ কহিলা হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি./ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ অর্থাৎ নারদ বুঝাইতে চাহিলেন-যাহা বাল্মীকি লিখিবেন, তাহাই হইবে সত্য। যাহা ঘটে, তাহা সত্য নহে।

কথাগুলি প্রতীকী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এই প্রতীকী অর্থেই বুঝাইয়া দেন-কী করিয়া ইতিহাস ও কাহিনি রচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন মনীষীর মনেও প্রশ্ন জাগে-ইতিহাস রচনার প্রকৃত রূপ কি সত্যের প্রতিফলন? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নহে, বরং বহু জটিল স্তরে নিহিত। প্রকৃত অর্থে, ইতিহাস যে সর্বদাই সত্যকে উপস্থাপন করে-এমন ধারণা গ্রহণ করা নিতান্তই ভ্রান্তমূলক। কারণ, ইতিহাস রচনা করে বিজয়ী পক্ষ, এবং সেই কারণেই যাহারা পরাজিত হয়, তাহাদের কাহিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হারাইয়া যায় বিজয়ীর মহিমার আড়ালে। যেই পক্ষ ইতিহাস লেখে, সেই পক্ষই ঘটনাবলির ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে। ফলে পরাজিতের কাহিনি, বেদনা এবং সংগ্রাম চাপা পড়ে। বিজয়ীর কাহিনি মহিমান্বিত হয়, আর সেই কাহিনিই প্রতিষ্ঠা পায় জনমানসে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি যেমন তাহাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে উপমহাদেশের ইতিহাস রচনা করিয়াছিল। ব্রিটিশ শাসনের সুফল ও সভ্যতার দানকে প্রধান করে উপস্থাপন করা হইয়াছে, অথচ তাহাদের শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনি লুকাইয়া রাখা হইয়াছে। ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রথম প্রচেষ্টা। 

প্রকৃতপক্ষে, ইহা ছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য এক বিরাট আন্দোলন, কিন্তু বিজয়ী ব্রিটিশ গোষ্ঠী তাহাকে ‘মিউটিনি’ বলিয়া ছোট করিয়া দেখাইয়াছে। এই জন্য জর্জ অরওয়েল বলিয়াছেন, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করিবার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হইল তাহাদের ইতিহাসকে অস্বীকার করা ও মুছিয়া ফেলা।’

বিজয়ীরা যখন ইতিহাসকে নিজেদের মতো করিয়া রচনা করেন, এবং তাহাদের স্বার্থে বিকৃত করেন এবং পরাজিতের সত্য কাহিনিগুলিকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেন-তখন ইতিহাসের এই বিকৃতরূপ পরবর্তী প্রজন্মের নিকট প্রকৃত সত্যকে ধোঁয়াশায় ঢাকিয়া রাখে। ফলে মানুষ সেই মিথ্যা ইতিহাসেই বিশ্বাস স্থাপন করে এবং প্রকৃত সত্য অনেক সময় চিরতরে হারাইয়া যায়। যেমন-মধ্যযুগে ক্রুসেডের বিবরণে দেখা যায়, খ্রিষ্টানদের বিজয় ও মহিমার কাহিনি প্রচারিত হইয়াছে, অথচ মুসলিমদের প্রতি নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনি লুকানো হইয়াছে। ইতিহাসের এই বিকৃত রূপই আজ আমাদের বিশ্বদর্শনকে প্রভাবিত করিয়া রাখিয়াছে। এই কারণে হেগেল বলিয়াছেন, ‘ইতিহাস হইতে আমরা যাহা শিখি, তাহা হইল-আমরা ইতিহাস হইতে কিছুই শিখি না।’

ইতিহাসের এই চক্রবদ্ধ বিকৃতি আমাদের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। আমরা যদি ইতিহাসের সত্যকে পুনর্মূল্যায়ন না করি, তবে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তিই করিয়া যাই। ইতিহাসের ভুল ও মিথ্যাকে চ্যালেঞ্জ করিয়া সত্য উদ্‌ঘাটনের প্রচেষ্টা প্রতিটি সচেতন জাতির মধ্যে জাগরূক থাকা প্রয়োজন।

Facebook Comments Box

Posted ৯:২০ এএম | শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।